এবার প্রত্যাশা পূরণের পালা - এম নজরুল ইসলাম

3046

Published on জানুয়ারি 6, 2019
  • Details Image

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় লাভ করেছে। বাংলাদেশবিরোধী জামায়াতকে রাজনৈতিক আশ্রয়দানকারী বিএনপি তথা ‘ড্রয়িং রুম পলিটিশিয়ান’দের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বিপক্ষে এ বিজয় কাঙ্ক্ষিত ছিল। আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোটের এ বিজয়ের নেপথ্যে প্রধান কারণটি হচ্ছে জনসাধারণের সার্বিক আস্থা। মানুষ আস্থা রেখেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ওপর। জামায়াতকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে ও সন্ত্রাসের রাজনীতি চর্চা করায় বিএনপি মানুষের আস্থা হরিয়েছে। আর সে কারণেই ভরাডুবি ঘটেছে তাদের।

অতি প্রগতিশীল কারো কারো মনে এমন প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, কেন এই ভূমিধস বিজয়। খুব ছোট করে বলা যায়, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ তো মুক্তিযুদ্ধেরই ফসল। অন্যদিকে বিএনপি জামায়াতকে রাজনৈতিভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দানকারী একটি দল। জামায়াত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই এবার প্রশ্ন করা যেতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশ কেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের পক্ষে যাবে। উপরন্তু গত এক দশকে বাংলাদেশের মানুষ তো উন্নয়নের চিত্র দেখেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ বাংলাদেশ বিশ্বে যে অবস্থান তৈরি করেছে, তার বিপরীতে তো দেশের মানুষ যাবে না। আমরা যদি একটু পেছনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই রূপকল্প ২০২১, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০, সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা ২০৪১ সামনে রেখে দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো ‘উন্নয়ন মহাসড়কে’ উঠেছে। দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি দৃশ্যমান। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা পর্যন্ত প্রায় ৬ দশমিক ১ কিলোমিটার সেতুটি নির্মাণের কাজ শেষ হলে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে।

রাজধানীতে মতিঝিল থেকে উত্তরা পর্যন্ত চলবে মেট্রো রেল। মেট্রো রেল স্থাপনের প্রকল্পে খরচ হবে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। রাজধানীর যানজট নিরসনে হাতে নেওয়া এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির কাজ চলছে। এরই মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেন করা হয়েছে। এই চার লেন মহাসড়কের পাশাপাশি নির্মাণ করা হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে। এ ছাড়া জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কও চার লেন করা হয়েছে। জয়দেবপুর থেকে এলেঙ্গা মহাসড়কও চার লেন করা হচ্ছে।

তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ এখন দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বে রোল মডেল। ৮৫ শতাংশ দারিদ্র্য নিয়ে যাত্রা শুরু করা দেশটি দ্রুত এই হার কমানোর ক্ষেত্রে নজিরবিহীন সাফল্য অর্জন করেছে। ৭০ ডলার মাথাপিছু আয় নিয়ে যাত্রা করা বাংলাদেশ তিনটি শর্তই পূরণ করে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে ২০২৪ সালেই। মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭৫২ ডলার। বিশ্লেষকরা বলছেন, দারিদ্র্য হ্রাস, উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ টেকসই উন্নয়নে বাংলাদেশের বড় সফলতা এসেছে গত ১০ বছরে। সরকারের ধারাবাহিকতার সঙ্গে উন্নয়ন নীতি-কৌশল বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় এটি অর্জন সম্ভব হয়েছে।

স্বাধীনতার ২৯ বছর পর ২০০০ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮.৯ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ১০ জনে পাঁচজনই দরিদ্র। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ যে জরিপ করেছে, তাতে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ২৪.৩ শতাংশ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে দেশে দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশ প্রক্ষেপণ করেছে। অর্থাৎ বর্তমানে প্রতি ১০ জনে দুজন দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। আর চলতি অর্থবছর শেষে তা আরো কমে ১৯.৮ শতাংশে দাঁড়াবে বলে প্রাক্কলন করেছে জিইডি। সরকার আশা করছে, ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে দরিদ্রের সংখ্যা কমে দাঁড়াবে ১০ জনে একজন। উন্নত দেশগুলোতেও ১০ শতাংশ দারিদ্র্য থাকে। এই পরিমাণ দারিদ্র্য কখনো দূর করা যায় না। কারণ নদীভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ সামাজিক বিভিন্ন কারণে দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে থাকা কিছু মানুষ হঠাৎ করেই দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে। তবে ২০৩০ সালের পর দেশে অতি দরিদ্র বলতে যা বোঝায়, তেমন মানুষ থাকবে না বলে আশা করছে সরকার।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সারা দেশে চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে কাজের সুযোগ বৃদ্ধি, প্রচলিত কৃষি খাত বাণিজ্যমুখী কৃষিতে রূপান্তর, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুতায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া আশ্রয়ণ, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পসহ বিশেষ এলাকার উন্নয়নের জন্য সরকার বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছে। দারিদ্র্য হার কমার পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে।

বৈশ্বিক গবেষণা সংস্থা প্রাইসওয়াটার কুপারসের (পিডাব্লিউসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০৫০ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতিতে পরিণত হবে। ওই সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হবে ০.৬ শতাংশ। গড় মাথাপিছু প্রকৃত আয় বাড়বে ৪.১ শতাংশ ও দেশীয় মুদ্রায় গড় জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হবে ৪.৮ শতাংশ। ওই সময় এই তিনটি সূচকে শুধু ভারত ও ভিয়েতনাম বাংলাদেশের চেয়ে ভালো করতে পারবে।

এখন থেকে ১০ বছর আগে দেশে বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা ছিল এক কোটি আট লাখ। সেটি এখন বেড়ে তিন কোটিতে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ এ সময়ে বিদ্যুতের গ্রাহক বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। ১০ বছর আগে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯৩২ মেগাওয়াট। তা বেড়ে হয়েছে ২০ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ এক দশকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে হয়েছে চার গুণ।

শেখ হাসিনার সরকারের আমলে আবার নতুন করে পাটের বাজার ফিরতে শুরু করেছে বিশ্ববাজারে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পাট খাতের রপ্তানি আয় ছিল ৪১ কোটি ৭৪ লাখ ডলার, যা বেড়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দ্বিগুণ হয়। চলতি বছর এ পর্যন্ত রপ্তানির পরিমাণ ৯১ কোটি ৯৫ লাখ ৮০ হাজার ডলার। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫৪ কোটি ২২ লাখ ডলার। কাজ চলছে রপ্তানিপণ্যের নতুন নতুন বাজার তৈরি করতেও।

বর্তমান সরকারের পর পর দুই মেয়াদের শাসনামলে গত ১০ বছরে আগের ১০ বছরের তুলনায় প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় চার গুণ। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, ২০০৮ থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ বছরে দেশ থেকে ৬০ লাখ ৭৩ হাজার ৯৬৯ জন কর্মী বিদেশে গেছে; যেখানে ১৯৭৬ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ৩১ বছরে বিদেশে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ছিল ৫৩ লাখ ৯০ হাজার ৯৭৪।

‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহারে ২১টি বিশেষ অঙ্গীকার ঘোষণা করেছে টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বিশেষ অঙ্গীকারের প্রথম দুটি হলো—প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ এবং তরুণ-যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। এবার ইশতেহারে এ দুটি বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ইশতেহারের ২১ বিশেষ অঙ্গীকার হলো—প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ; তরুণ-যুবসমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর; কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা; দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ; নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ সমতা ও শিশু কল্যাণ; পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা; সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূল; মেগা প্রজেক্টগুলোর দ্রুত ও মানসম্মত বাস্তবায়ন; গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢ় করা; দারিদ্র্য নির্মূল; সব স্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধি; সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি; সবার জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা; সার্বিক উন্নয়নে ডিজিটাল প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার; বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা; আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার লক্ষ্য যান্ত্রিকীকরণ; দক্ষ ও সেবামুখী জনপ্রশাসন; জনবান্ধব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা; ব্লু-ইকোনমি, সমুদ্রসম্পদ উন্নয়ন; নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা; প্রবীণ, প্রতিবন্ধী ও অটিজম কল্যাণ এবং টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন।

নির্বাচনী ইশতেহারে তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি পর্যায়ক্রমে দেশের প্রতিটি উপজেলায় প্রসারিত করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়ে মেধা ও দক্ষতা বিবেচনায় রেখে বাস্তবতার নিরিখে যুক্তিসংগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জাতীয় পর্যায়ে স্বল্প, মধ্যম ও উচ্চশিক্ষিত তরুণদের তথ্যসংবলিত একটি ইন্টিগ্রেটেড ডাটাবেইস তৈরি করা হবে। ২০২৩ সাল নাগাদ অতিরিক্ত এক কোটি ৫০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। এ ছাড়া ওই সময়ে নতুনভাবে এক কোটি ১০ লাখ ৯০ হাজার মানুষ শ্রমশক্তিতে যুক্ত হবে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে দেশের তরুণ ও যুবশক্তিকে দেশের কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে।

ইশতেহার ঘোষণার দিন স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্যাপনের সময় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী কোনো শক্তি এ সময় ক্ষমতায় থাকলে, তা হবে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গ্লানিকর। তাই দেশবাসীর প্রতি আমার আকুল আবেদন, আগামী ৩০ তারিখে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আবার আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করুন। আপনারা নৌকায় ভোট দিন, আমরা আপনাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন করে দেব, এটা আমাদের জাতির কাছে ওয়াদা।’

দেশের জনগণ ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করেছে। এবার জনগণের প্রত্যাশা পূরণের পালা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে নতুন এক বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

 

সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত