বিএনপি-জামায়াত শাসনামল: খালেদা জিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠতার জেরে হাজার কোটির মালিক, হুন্ডি ও অর্থ পাচারের অন্যতম হোতা মোসাদ্দেক আলী ফালু

1006

Published on নভেম্বর 17, 2022
  • Details Image

মোসাদ্দেক আলী ফালু- বাংলাদেশের এক মহা-বিতর্কিত চরিত্র। খালেদা জিয়া ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় অবৈধভাবে হাজার কোটি টাকার মালিক হয় সে। হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অর্থ পাচার করে বিদেশের মাটিতেও গড়ে তোলে একাধিক ব্যবসা। কৌশলে ভূমি ও জলাশয় দখল, ঠিকাদারদের কাছ থেকে কাজের পারসেনটেজ এবং সরকারি সম্পদ লুটপাট করে মিডিয়া সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল সে। খালেদা জিয়ার কারণে ফালুর নামে মুখ খোলার সাহস পেতো না কেউ। কিন্তু দৃশ্যপট বদলে যায় ২০০৭ সালে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রকাশিত হতে থাকে একের পর এক প্রতিবেদন। ফালুর সম্পদের পরিমাণ দেখে অবাক হয়ে যায় তদন্তকারীরাও।

২০০৭ সালের ১ জুন তারিখের প্রথম আলো পত্রিকার সংবাদ থেকে জানা যায়, জোট সরকারের শেষের দিকে দুর্নীতি ও লুটের টাকা পাচার এবং বিদেশে নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য ২০০৬ সালে ১০ বার সৌদি আরব যায় সে। এছাড়াও লন্ডন ও মালয়েশিয়াতে তেলের ব্যবসায় বিনিয়োগ, সৌদি আরবসহ পাঁচটি দেশে বিশেষ অ্যাকাউন্ট, এমনকি দেশের মধ্যে ফালুর ১৫টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মূলত, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ও এমপি থাকার সময় অবৈধভাবে অগাধ টাকা, শত শত বিঘা জমি, অজস্র বাড়ি ও ব্যবসার মালিক হয় সে।

এমনকি নামে-বেনামে হুন্ডির মাধ্যমে ফালুর শত শত কোটি টাকা পাচারের বিষয়ে আলোচনা পর্যন্ত হয়েছে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে। কারণ বাংলাদেশে খালেদা সরকারের পতন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হলে, ব্রিটেনের একটি মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যায়। যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয় ব্রিটিশ সমাজেও।

২০০৭ সালের ২০ জুলাই দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকা থেকে জানা যায়, ২০০৬ সালের শেষের দিকে ব্রিটেনের ফার্স্ট সলিউশন মানি ট্রান্সফার লিমিটিড নামের একটি মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি দেউলিয়া ঘোষণা করে নিজেকে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালু অর্থ পাচার করতো কিনা তা পার্লামেন্টে জানতে চান ব্রিটিশ এমপিরা। এমনকি ব্রিটেন থেকে পরিচালিত ফালুর 'চ্যানেল এস' এর কার্যক্রমের বিষয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।

ব্রিটিশ এমপি জর্জ গ্যালওয়ে পার্লামেন্টে জানান, বাংলাদেশে সরকার পতনের পর দেউলিয়া ঘোষণা করা ব্রিটিশ মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানিটির বিরুদ্ধে আগেও অনেক অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের কারণে ফার্স্ট সলিউশনের অবৈধ অর্থের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, এবং এরফলে প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হয়ে যায়- এরকম কিছু ঘটেছে কিনা তা তদন্ত করার আহ্বান জানান তিনি।

২০০৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দৈনিক সংবাদ পত্রিকা জানায়, ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দেশজুড়ে যে হরিলুট এবং অর্থপাচায় চালিয়েছে, সেজন্যই পরপর ৫ বার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে- ওই পাঁচ বছরে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তালিকায় শীর্ষে থাকা তারেক রহমান ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের পরপরই শীর্ষে রয়েছে ফালুর নাম।

দুর্নীতি দমন কমিশন আরও জানায়- এসবের বাইরেও ফালু ও তার পরিবাদের সদস্যদের নামে শাহজাহানপুরে একটা সাত তলা ও দুটি পাঁচ তলা বাড়ি, পুরনো ডিওএইচএসে সাড়ে আট কাঠার জমির ওপর ছয় তলা বাড়ি, গুলশানে দুটি প্লটে দেড় বিঘা জমি, তেজকুনী পাড়ায় চারটি প্লটে আড়াই বিঘা, তেজগাঁওয়ে দুটি প্লটে দশ কাঠা, মিরপুরে চার কাঠা এবং মগবাজারে তিন বিঘা জমি আছে। সাভারে আছে আরো ১০৯ বিঘা জমি। আশিয়ান সিটিতে দশ কাঠা, বসুন্ধরার দুটি প্লটে ১৫ কাঠা এবং গাজীপুরে আড়াই বিঘা জমির সন্ধান পাওয়া যায়।

এমনকি নিজের নামে বিদেশে পাঁচটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে ফালুর। ২০০৫ সালে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার পর, ২০০৬ সালেই ১০ বার সৌদি আরব ভ্রমণে যায় সে। তার নামে ও বেনামে মোট কতো সম্পদ থাকতে পারে; তা মেলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে গোয়েন্দাদের।

এরপরও কারসাজি করে সরকারি জমি দখল করেছে এই ধনাঢ্য ব্যক্তি। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা মূল্যের সরকারি প্লট অনিয়ম করে পানির দামে কিনে নিয়েছে সে। এমনকি সরকারি জলাশয় দখল থেকেও পিছিয়ে ছিল না ফালুর লোকজন। বিএনপি-জামায়াত সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে দেশজুড়ে নদী ও জলাশয় দখলের মহোৎসব চালায় নেতারা। ঢাকার বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদী ভরাট করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয় বিএনপি নেতা নাসিরুদ্দীন পিন্টু, সালাউদ্দীন আহমেদ, গিয়াসউদ্দীন সেলিমরা। রাজধানীর বাইরে এই জবর-দখল অব্যাহত রাখে বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব এবং প্রভাবশালী বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালু গং।

২০০৭ সালের ৩ এপ্রিল দৈনিক সমকালে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ফেনী শহরের ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাঙ্ক রোডের পশ্চিমাংশে ৫০ শতকের একটি সরকারি জলাশয় দখল করে ফালুর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী এনামুল হক চৌধুরী সেলিম। আগে ফেনীতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি হলেও, বিএনপি-জামায়াত আমলে মোসাদ্দেক আলী ফালু সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। এরপর ফালুর সহায়তায় অগ্রণী কন্সট্রাকশন এবং নবারুণ বিল্ডার্স নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং কিছু মন্ত্রণালয় থেকে কোটি কোটি টাকা লোপাট করে সে।

ফালুর প্রভাবে রাতারাতি ঢাকা ও ফেনী শহরে শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া সেলিম ২০০৩ সালের ৩১ মার্চ অবৈধভাবে সরকারি জলাশয়টি নিজের নামে কিনে নেয়। ভূমি আপিল বোর্ড এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিলেও ফালুদের নির্দেশে তা পাশ কাটিয়ে যায় তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোস্তফা। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ক্ষমতার জোরে ২০ লাখ টাকা শতকের জমি মাত্র ৬০ হাজার শতক হিসেবে কিনে নেয় সেলিম। এরপর তা ভরাট করে টিনের লম্বা ঘর তুলে দোকান এলাকা হিসেবে ভাড়া দিয়ে দেয়। প্রশাসন ও আদালত শত চেষ্টা করেও তখন সেই জমিতে ঢুকতে পারেনি।

এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়া, ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া এবং ঠিকাদারি কাজের কমিশন থেকেও কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেছে মোসাদ্দেক আলী ফালু। তাদের দুর্নীতি, লুটপাট এবং অর্থ পাচারের কারণে ভেঙে পড়েছিল দেশের অর্থনীতি। রেমিটেন্স হয়ে পড়েছিল প্রায় শূন্য। সন্ত্রাস ও দারিদ্রে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল দেশের মানুষ।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত