বিএনপি-জামায়াত দুঃশাসন: সরকারি ভূমি দখল, নিয়োগ বাণিজ্য, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির হোতা হয়ে ওঠে মির্জা আব্বাস

1417

Published on নভেম্বর 17, 2022
  • Details Image

২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অন্যতম গডফাদার ছিল বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হওয়ায় একই সাথে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং হাওয়া ভবনের নানাবিধ অপকর্মের ক্রীড়নক হয়ে ওঠে সে। মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, ভূমি দস্যুতা ও চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট গড়ে ঢাকাকে পরিণত করে ক্রাইম সিটিতে। তাদের সীমাহীন দুর্নীতি ও অপকর্মের কারণে এসময় পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ।

২০০১ সালের ২০ অক্টোবর, সরকার গঠনের পরপরই কারাগারে বন্দি থাকা দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মুক্তি দিতে শুরু করে বিএনপি-জামায়াত সরকার। তারেক রহমানের গ্রিন সিগন্যাল অনুসারে, তালিকা ধরে ধরে সিরিয়াল কিলারদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ঢাকাকে চারভাগ করে চার এমপিকে দেওয়া হয় সন্ত্রাসীদের দেখভালের দায়িত্ব। ঢাকার টেন্ডারবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে তারেক রহমানের হয়ে সুব্রত সাইন, আরমান, সাগর, তাজসহ কুখ্যাত এই সন্ত্রাসীদের তত্ত্বাবধান করতো যারা, তাদের মধ্যে অন্যতম হল মির্জা আব্বাস।

২০০৭ সালের ১১ অক্টোবর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা থেকে জানা যায়, ২০০১ সালে নির্বাচনের আগে তেজগাঁও ছাত্রদলের এজিএস ইমাম ও লম্বু সেলিমের মাধ্যমে হাওয়া ভবনের সঙ্গে যোগাযোগ হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীরের। সেসময় নির্বাচনে জিততে যা কিছু করার, সব করার জন্য কালা জাহাঙ্গীরকে অনুরোধ করে তারেক রহমান। বিনিময়ে পরবর্তীতে কালা জাহাঙ্গীরের গ্রুপকে সর্বোচ্চ সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। এমনকি শীর্ষ সন্ত্রাসী টোকাই সাগরকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে মহানগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদকের পদ দেওয়া হয় তারেকের নির্দেশে।

এমনকি বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলের পাঁচ বছরে শুধু গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকেই হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটপাট করে স্বজনদের জন্য বরাদ্দ করান স্বয়ং খালেদা জিয়া। তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী মির্জা আব্বাসের মাধ্যমে এটি করেন তিনি। ২০০৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারির দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- খালেদা জিয়ার ভাগ্নে শাহরিন ইসলাম তুহিন, তার ভাই নুরুন নেওয়াজ সেলিম, রাজনৈতিক সচিব ও ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি মোসাদ্দেক আলী ফালু, নুরুল ইসলাম মনি, এ কালাম আজাদ, মো. নাজিমুদ্দিন, সাঈদ ইস্কান্দার, সানজি প্রোপার্টিজ প্রমুখের মধ্যে হাজারকোটি টাকা মূল্যের জমি ও বাড়ি বণ্টন করে দেওয়া হয়।

রাজধানীর গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, ইস্কাটনে ২৯টি সরকারি বাড়ি ও জমি সিন্ডিকেট করে পানির দামে বিক্রি করে দেওয়া হয় মির্জা আব্বাসের নির্দেশে। মোট ৩৯১ কাঠা জমির ওপর তৈরি এসব বাড়ির বাজার দর ছিল ওইসময় ৮০০ কোটি টাকার ওপর। কিন্তু বাজার দরের এক দশমাংশ দামে এসব বাড়ি বিক্রি করেছে রাজউক। গুলশানের দেড় থেকে দুই কোটি কাঠা মূল্যের এসব বাড়ি বিক্রি করা হয়েছে মাত্র ১০ থেকে ১৫ লাখ কাঠা দরে।

২০০৭ সালের ২৮ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার আরেকটি সংবাদ থেকে জানা যায়, ২০০৬ সালে টেন্ডার ছাড়াই তড়িঘড়ি করে রেলওয়ের ২ একর জমি একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে মাত্র ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকার বিনিময় লিজ দেয় গণপূর্ত মন্ত্রী মির্জা আব্বাস। এই সম্পদের মূল্য ছিল তখন কমপক্ষে ৫১ কোটি টাকা। অথচ রেলওয়ের জমি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়, তাই এটি করার আইনগত অধিকার মির্জা আব্বাসের ছিল না। এই ঘটনায় রেলওয়ে প্রতিবাদ জানায়, মির্জা আব্বাসের ক্যাডার বাহিনীর প্রতাপের কাছে হেরে যায় সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। খালেদা জিয়ার শাসনামলে এভাবেই সন্ত্রাসীদের ক্ষমতার দাপটে নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি কোথাও।

এছাড়াও প্রভাব খাটিয়ে সরকারি জমি দখল, পানির দামে কোটি টাকার সরকারি প্লট বিক্রি এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ বাণিজ্য করে অবৈধভাবে শত কোটি টাকার মালিক হয় বিএনপি নেতা আব্বাস। এমনকি তার হরিলুটের নিয়োগ বাণিজ্যে বাধা দিলে, সরকারি কর্মকর্তাদের পোস্টিং করানোটা ছিল তার জন্য এক সেকেন্ডের ব্যাপার।

১৭ জুন ২০০৭ সালের সমকাল পত্রিকা থেকে জানা যায়, ২০০৬ সালের শেষের দিকে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষে ৭১ জনকে দ্রুততার সাথে চাকরি দেয় প্রতিমন্ত্রী আব্বাস। ২০ আগস্ট পত্রিকায় চাকরির বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর, শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে ৪ থেকে ৬ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়। কিন্তু এই হরিলুটের নিয়োগে বাধা হয়ে দাঁড়ায় সংস্থার তৎকালীন চেয়ারম্যান মতিয়ার রহমান। এরপর প্রতিমন্ত্রী আব্বাস তাকে সাভারে প্রশিক্ষণে পাঠানোর নামে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়। এরপর ৬ অক্টোবর একই প্রশ্নে- দুই শিফটে- ভিন্ন ভিন্ন সব পদের পরীক্ষা হয় এবং ২০ অক্টোবর তালিকাভুক্ত প্রার্থীদের হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেওয়া হয়।

এমনকি কোটি কোটি টাকা দুর্নীতির বিনিময়ে রেলের ৭৮ কোটি টাকা মূল্যের জমি মাত্র ৫ কোটিতে বিক্রি করে দেন এই বিএনপি নেতা। ২০০৭ সালের ১৯ মার্চ জনকণ্ঠের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়- সরকারের শেষের দিকে এসে শাহজাহানপুরে রেলওয়ের ১৩ একর জমি প্লট আকারে বিক্রি করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। মন্ত্রী মির্জা আব্বাস দুর্নীতির মাধ্যসে নিজের স্বজন ও দলীয় লোকদের কাছে এই জমি বরাদ্দ দেয়। ২০০৬ সালে ঢাকার শাহজাহানপুর এলাকায় জমির দাম ছিল কাঠাপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। অথচ প্রতি বিঘা জমি মাত্র ৪০ লাখ টাকা দরে বিক্রি করে দেওয়া হয় মির্জা আব্বাসের নির্দেশে। বাজারদর অনুসারে এই জমির দাম তখন ৭৮ কোটি টাকা হলেও, মাত্র ৫ কোটি ২০ লাখ টাকায় তা বিক্রি করা হয়। কমপক্ষে ৭৩ কোটি টাকা কম মূল্যে এসব জমি বিক্রি করে বিপুল অঙ্কের অর্থ লুটপাট করে মির্জা আব্বাস।

এছাড়াও ১২ মার্চ, ২০০৭ সালের যুগান্তর পত্রিকার সংবাদ থেকে জানা যায়- নির্বাচনের মনোনয়ন ও দলীয় কমিটিতে পদ দেওয়ার বিনিময় নেতাকর্মীদের কাছ থেকে কয়েকশ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছিল হাওয়া ভবন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌথ বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদে তারেক এই ঘটনা স্বীকার করে। তারেক জানায়, যে ৩০ জন নেতার মাধ্যমে সারা দেশে পোস্ট-পদবি বিতরণ ও মনোনয়নেন বিষয়গুলো ঠিক করা হতো, তাদের অন্যতম হলো মির্জা আব্বাস। তাদের মাধ্যমেই এই অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল।

সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে মন্ত্রণালয়, সরকারি অফিস এবং রাজধানীজুড়ে ব্যাপক ত্রাস সৃষ্টি করে মির্জা আব্বাস। খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হওয়ায়, অনেক বড় দুর্নীতি করলেও গণমাধ্যম পর্যন্ত কোনো সংবাদ প্রকাশের সাহস পেতো না। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর, সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ- সবাই এসব অনিময়, দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসের ব্যাপারে অভিযোগ করে যৌথ বাহিনীর কাছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে একের পর এক বেরিয়ে আসে মির্জা আব্বাসের অপকর্মের ঘটনা।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত