সেনা বিদ্রোহে নয়, পরিকল্পিত খুন

3809

Published on আগস্ট 15, 2021
  • Details Image

এম. ইনায়েতুর রহিমঃ

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অতিপ্রত্যুষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নির্মম-বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে দেশবাসী হতবিহ্বল ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। বিক্ষিপ্ত কিছু প্রতিবাদ হলেও কার্যকর কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি- এটা সত্য ও বাস্তবতা।

২৬ সেপ্টেম্বর '৭৫ দখলদার রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমেদ 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, ১৯৭৫' জারি করে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ ১৫ আগস্টে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দায়মুক্তির পথ করে দেয়। পরবর্তী সময়ে জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করে খুনের সঙ্গে জড়িত প্রায় সবাইকে বিদেশের কূটনৈতিক মিশনে চাকরি প্রদান করে পুরস্কৃত করেন। আত্মস্বীকৃত ঘাতকদের পুরস্কৃত করার এমন নজিরও বিশ্বে বিরল। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা পায় দীর্ঘ সময় ধরে অর্থাৎ জিয়া-এরশাদ ও বেগম জিয়ার শাসনামল পর্যন্ত। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে ২ অক্টোবর, ১৯৯৬ বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের হত্যা সংক্রান্তে ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলার তদন্ত শেষে মোট ২০ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ঢাকার দায়রা জজ আদালতে বিচারকাজ শুরু হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২০বি/৩০২/৩৪ এবং ২০১ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। এক আসামি মিসেস জোবাইদা রশিদ চার্জ গঠনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন দায়ের করে মামলা থেকে অব্যাহতি পান। রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক আদালতে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ঢাকার বিজ্ঞ দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ৮ নভেম্বর ১৯৯৮ রায় ও আদেশে ১৯ আসামির মধ্যে ১৫ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে সবাইকে 'মৃত্যুদণ্ড' প্রদান করেন। অন্য চারজন খালাস পান।

আইন অনুযায়ী 'মৃত্যুদণ্ড' আদেশ অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে রেফারেন্স পাঠানো হয়। হাইকোর্টে নানান নাটকীয়তার পর হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হয়। বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারক এ বি এম খায়রুল হক সব দণ্ডিতের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলেও জ্যেষ্ঠ বিচারক মো. রুহুল আমিন ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন এবং পাঁচজনকে খালাস প্রদান করেন। ফলে ডেথ রেফারেন্সটি তৃতীয় বেঞ্চে গড়ায়। তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি ফজলুল করিম ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন এবং তিনজনকে খালাস প্রদান করেন।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডিত পাঁচজন আপিল বিভাগে 'লিভ পিটিশন' দাখিল করে। আপিল বিভাগ দণ্ডিতদের উত্থাপিত পাঁচটি আইনি প্রশ্ন নিষ্পত্তির জন্য লিভ মঞ্জুর করেন। দণ্ডিতদের অন্যতম একটি আইনগত প্রশ্ন ছিল- 'যেহেতু সেনা বিদ্রোহের ফলে রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবারের সদস্যরা নিহত হয়েছিলেন, সুতরাং এটা সাধারণ বা প্রচলিত কোনো খুন নয়; এবং সে কারণে প্রচলিত আদালতে এ খুনের বিচার ছিল এখতিয়ারবহির্ভূত, যা সমগ্র বিচার কার্যক্রমকে কলুষিত (vitiate) করেছে।'

অপর আরও একটি ছিল- 'রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক উত্থাপিত সাক্ষ্যসমূহ প্রমাণ করে না যে, তর্কিত হত্যাকে সংঘটিত করার জন্য আপিলকারীরা কোনো 'অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র' (criminal conspiracy) করেছিল, বরং সামরিক বিদ্রোহ হয়েছিল মুজিব সরকারের পরিবর্তনের জন্য। সুতরাং দণ্ডবিধির ১২০বি ধারা অনুযায়ী দণ্ডিতরা কোনো অপরাধ করেনি।'

আপিলকারীদের পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবীরা যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, উত্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে প্রকাশ পায় যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবার-পরিজনদের হত্যাকাণ্ড এবং ক্ষমতার পটপরিবর্তন ছিল কিছুসংখ্যক সেনা অফিসারের বিদ্রোহের ফল, সে কারণে এই বিচারকাজটি ১৯৫২ সালের সেনা আইনের বিধান অনুযায়ী 'কোর্ট মার্শালে' অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল; কেননা, ঘটনার উৎপত্তি ছিল ঢাকা সেনানিবাসে। সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ও ন্যাশনাল ইউনিটের অফিসার ও জওয়ানরা ঢাকা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রপতি, যিনি সশস্ত্র বাহিনীরও সর্বাধিনায়ক ছিলেন, তাকে হত্যা করেছিল; যেমনিভাবে ১৯৮১ সালের ২৯ মে দিবাগত রাতে সেনাসদস্যরা চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যেখানে তিনি অবস্থান করছিলেন সেই সার্কিট হাউসে তাকে হত্যা করে। উভয় হত্যাকাণ্ড যেহেতু একইভাবে সংঘটিত হয়েছিল, সেহেতু আসামিরা ১৫ আগস্টের ঘটনার সঙ্গে আদৌ জড়িত থেকে থাকলে তাদের বিচার 'কোর্ট মার্শালে' হওয়া উচিত ছিল; যেমনটি হয়েছিল জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রে।

আপিলকারীদের বিজ্ঞ আইনজীবীরা আরও যুক্তি দেখান যে, ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতের ঘটনায় কোনো অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার কিংবা সেনা আইনের অধীন নয়, এমন অপর কোনো ব্যক্তি যোগ দিয়ে থাকলেও সেনা আইনের ৩১ ধারার পরিসীমার মধ্যে সেটাও হবে বিদ্রোহ এবং তদানুযায়ী তাদেরও সেনা আইনের অধীনে কোর্ট মার্শালে বিচার করা উচিত ছিল। যেহেতু ১৪ আগস্ট রাতে ঢাকা সেনানিবাস থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাটির উৎপত্তি হয়েছিল, সেহেতু স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, ঘটনাটি ছিল একটা সহজ-সরল সেনা বিদ্রোহ এবং তদুপরি দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা কিংবা ১২০খ ধারার আওতাধীনে সংক্রান্ত কোনো চুক্তি বা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র বা পূর্ব পরিকল্পিত বা পূর্ব আয়োজিত পরিকল্পনার অস্তিত্ব ছিল না। উপরন্তু রাষ্ট্রপতি সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হওয়ায় তার হত্যাকান্ডের বিচার কোর্ট মার্শালে হওয়া উচিত ছিল। যুক্তির সমর্থনে বিজ্ঞ আইনজীবীরা জামিল হক বনাম বাংলাদেশ, ৩৪ ডিএলআর (এডি), পৃষ্ঠা-১২৫ মামলাটি অর্থাৎ জিয়াউর রহমানের হত্যার বিষয়ে কোর্ট মার্শালে বিচার বিষয়ে আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করেন।

অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীদের যুক্তি ছিল, আপিলকারীরা সর্বোচ্চ আদালতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (বাতিল) আইন চ্যালেঞ্জ করলেও বিচারিক আদালতের এখতিয়ার নিয়ে বিচার চলাকালে কখনও কোনো আপত্তি বা প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। সুতরাং বর্তমান পর্যায়ে এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন অসৎ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। হত্যাকাণ্ডটি যেহেতু পূর্বপরিকল্পিত, সেহেতু ফৌজদারি কার্যবিধির অধীনে প্রচলিত আদালতে বিচার সম্পন্ন করায় আইনগতভাবে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি; এবং সেনা আইন, নৌবাহিনী অধ্যাদেশ ১৯৬১ এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৫৪৯-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো অবস্থান তৈরি হয়নি। তাদের আরও যুক্তি ছিল যে, সেনা আইনের ধারা ৫৯(২) ও ৮(২) ধারা একত্রে পাঠ করলে দেখা যাবে যে, সংঘটিত ঘটনাটি একটি 'সিভিল অপরাধ', যা সেনা আইনের ধারা ৯৪ অনুযায়ী বিচারের এখতিয়ার ফৌজদারি আদালতের রয়েছে।

আপিল বিভাগ উভয় পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীদের যুক্তি, সেনা আইন, নৌবাহিনী অধ্যাদেশ ও ফৌজদারি কার্যবিধি, দণ্ডবিধি ও উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণাদি পর্যালোচনাক্রমে আপিলকারীদের কর্তৃক প্রচলিত ফৌজদারি আদালতে বিচার প্রক্রিয়ার বৈধতা সম্পর্কে উত্থাপিত আপত্তি নাকচ করেন অন্যতম এই কারণে যে, বিচারিক আদালতের এখতিয়ার নিয়ে আসামি পক্ষে বিচার চলাকালীন কখনই কোনো আপত্তি বা প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়নি; এমনকি আসামিদের ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারা অনুযায়ী পরীক্ষার সময়েও এ বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য ছিল না; সুতরাং এ পর্যায়ে এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপনের কোনো সুযোগ নেই। আপিল বিভাগ অভিমত প্রদান করে যে, সেনা আইনের ৩১ ধারায় 'বিদ্রোহে'র শাস্তির বিধান উল্লেখ থাকলেও ওই আইনে বিদ্রোহের কোনো সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি, সেক্ষেত্রে নৌবাহিনীর অধ্যাদেশ, ১৯৬১-এর ৩৫ ধারায় 'বিদ্রোহে'র যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে সেনা আইনের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে।

'বিদ্রোহ' তখনই হবে, যখন সশস্ত্র বাহিনীর আইনের অধীন দুই বা ততোধিক ব্যক্তি কিংবা মিলিত ব্যক্তিদের মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর আইনের অধীন অন্তত দু'জন ব্যক্তি একত্রিত হয়ে- ক. বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের অথবা সেই বাহিনীসমূহের সঙ্গে সহযোগিতাকারী যে কোনো বাহিনীর কিংবা উক্ত বাহিনীসমূহের যে কোনো একটির যে কোনো অংশের আইনসম্মত কর্তৃপক্ষকে উৎখাত করে বা প্রতিহত করে; খ. অবাধ্যতার দ্বারা যদি বাহিনীর শৃঙ্খলা ধ্বংস করা হয় কিংবা কোনো কর্তব্য বা দায়িত্ব (সার্ভিস) এড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে অথবা শত্রুর বিরুদ্ধে কার্যক্রমের বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে অমান্য করে; কিংবা গ. সশস্ত্র বাহিনীতে অথবা সেই বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতাকারী যে কোনো বাহিনীতে কিংবা সশস্ত্র বাহিনীসমূহের যে কোনো বাহিনীর যে কোনো অংশে যে কোনো কর্তব্য বা দায়িত্ব সম্পাদনে বাধা সৃষ্টি করে।

সাক্ষ্য-প্রমাণাদি বিশ্নেষণে আপিল বিভাগ সুস্পষ্ট অভিমত দেন যে, আলোচ্য মামলার ক্ষেত্রে সামরিক বিদ্রোহের উপরোক্ত উপাদানসমূহ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত অর্থাৎ আপিলকারী ও অন্যান্য আসামি যৌথভাবে সেনা কর্তৃপক্ষের অবাধ্য হয়েছে বা উৎখাতের চেষ্টা করেছে বা কর্মে অস্বীকৃতি জানিয়েছে বা কর্তব্যে অবহেলা করেছে বা আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এমন উপাদান পরিলক্ষিত হয়নি।

আপিল বিভাগ আরও অভিমত দিয়েছে যে, 'সেনা আইনের পঞ্চম অধ্যায়ে হত্যা' অপরাধের সংজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। দণ্ডবিধির ৩০০ ধারায় হত্যার অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। যখন সেনা আইন অনুসারে কোনো বিদ্রোহের অপরাধ সংঘটিত হয় তখন এটা শুধু 'কোর্ট মার্শাল' দ্বারা বিচার্য। সেনা আইনের ৫৯(১) ধারায় বলা আছে যে, উপধারা (২) এর বিধানাবলি সাপেক্ষে সেনা আইনের অধীন কোনো ব্যক্তি যদি কোথাও 'সিভিল অপরাধ' সংঘটিত করে, তাহলে সে সেনা আইনের অধীনে অপরাধের জন্য দোষী বলে গণ্য হবে; এবং সেনা আইনের ৮(২) ধারায় প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী 'সিভিল অপরাধ' বলতে এমন অপরাধকে বোঝায়, যা বাংলাদেশে সংঘটিত হলে ফৌজদারি আদালত কর্তৃক বিচার্য। এই আইনের ৮(৭) ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশে অবস্থিত অথবা সরকারের অনুমতিক্রমে অন্য কোথাও প্রতিষ্ঠিত সাধারণ ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার আদালতকে ফৌজদারি আদালত বলা হয়েছে। কাজেই এ ব্যাপারে কোনো বিরোধ বা বিতর্কের অবকাশ নেই যে, আপিলকারীদের কার্যকলাপ 'সিভিল অপরাধে'র মতো দুস্কর্মের মধ্যে পড়ছে। ফৌজদারি কার্যবিধির অধীনে গঠিত একটি ফৌজদারি আদালতে আপিলকারীদের বিচারের ব্যাপারে কোনো আইনগত বাধা ছিল না। অবশ্য সেনা আইনের ৫৯(২) ধারায় উল্লেখ আছে যে, সেনা আইনের আওতাধীন কোনো ব্যক্তি যদি সেনা আইনের বহির্ভূত কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে (ভিকটিম) তাহলে সে সেনা আইনের অধীনে বিচারযোগ্য হবে না যদি না সে ক. 'সক্রিয় কর্মে' (ধপঃরাব ংবৎারপব) থাকাকালীন অবস্থায় অথবা খ. বাংলাদেশের বাহিরে কোনো জায়গায় অথবা গ. সীমান্তবর্তী কর্মস্থলে এই অপরাধ করে। অর্থাৎ, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি (ভিকটিম) যদি সেনা আইন দ্বারা বাধ্য না হন এবং অপরাধ সংঘটনের সময় অপরাধীরা যদি 'সক্রিয় কর্মে' থেকে সেনা আইন দ্বারা বাধ্য না হন। সেনা আইনের ৮(১) ধারা অনুযায়ী 'সক্রিয় কর্মে' বলতে সেই সময়কে বোঝায়, যে সময়ে এই রকম ব্যক্তি সামরিক অভিযানে অথবা শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযানে নিয়োজিত কোনো বাহিনীতে সংযুক্ত থাকে, অথবা শত্রু দ্বারা দখলকৃত একটি বাহিনীর একটি অংশ হয় ...। আলোচ্য মামলায় আপিলকারীদের কেউ সেনা আইনের ৮(১) ধারায় সংজ্ঞায়িত 'সক্রিয় কর্মে' নিয়োজিত ছিল না; এবং যেহেতু, ধারায় উল্লিখিত তিনটি বিকল্প শর্তের কোনোটাই পূরণ হয়নি সেহেতু, ৫৯ ধারায় (২) উপ-ধারা অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তিগণের বিচার সেনা আইনের অধীনে হতে পারে না। উপরন্তু, আপিলকারী ও অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হয়নি যে, 'সক্রিয় কর্মে' থাকাকালীন অবস্থায় তারা হত্যা-অপরাধ করেছে এবং আপিলকারীরাও দাবি করেনি যে, তাদের 'সক্রিয় কর্মে' থাকাকালীন অবস্থায় ওই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। রেকর্ডভুক্ত এমন উপকরণও নেই, যা থেকে প্রমাণ হয় যে আপিলকারীরা শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযানে নিয়োজিত থাকাকালে কিংবা সামরিক অভিযানে নিয়োজিত থাকাকালে অথবা শত্রু কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকভাবে অধিকৃত কোনো দেশ বা স্থান অভিমুখে অগ্রসরমান থাকাকালে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল।

আপিল বিভাগ পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করে যে, বিচারিক আদালত সেনা আইনের ধারা ৯৪ এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৫৪৯-এর বিধান অনুযায়ী সংশ্নিষ্ট সেনা কর্তৃপক্ষকে আসামিদের বিরুদ্ধে বিচারের বিষয়টি অবহিত করলে সেনা সদর দপ্তর থেকে আদালতে জানানো হয় যে, সেনা আইনের ৯৪ ধারা অনুযায়ী প্রচলিত ফৌজদারি আদালতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের বিচার কার্যক্রমে কোনো বাধা নেই। সুতরাং আপিলকারীদের বিচার প্রচলিত ফৌজদারি আদালতে অনুষ্ঠানে কোনো পদ্ধতিগত ত্রুটি হয়নি এবং আদালত সম্পূর্ণ এখতিয়ার সম্পন্ন ছিল।

আপিল বিভাগ আরও অভিমত দেন যে, বর্তমান মামলায় উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ হতে এমন কিছু প্রমাণ হয় না যে, সেনাবাহিনীর যথাযথ কর্তৃপক্ষ আপিলকারী ও অন্যান্য আসামির বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ লঙ্ঘন বা অবাধ্যতা বা শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছিল, যার জন্য 'কোর্ট মার্শাল' হতে পারত।

আপিলকারীদের বিজ্ঞ আইনজীবীবৃন্দ কর্তৃক নির্ভরকৃত 'জামিল হক বনাম বাংলাদেশ সরকার' মামলার বিষয়ে আপিল বিভাগ অভিমত দেন যে, ওই মামলায় রিট আবেদনকারীদের ১৯৮১ সালের ২৯ মার্চ দিবাগত রাতে সংঘটিত বিদ্রোহের অপরাধের জন্য সেনা আইনের অধীনে কোর্ট মার্শালে বিচার ও দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। ওই বিদ্রোহের পরিণতিতে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রাণ হারিয়েছিলেন। অভিযুক্তরা সেনা আইনের অধীনে গঠিত 'কোর্ট মার্শালে'র সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে রিট করেছিলেন। হাইকোর্ট বিভাগ রিট পিটিশনটি রক্ষণীয় নয় মর্মে খারিজ করে, যা আপিল বিভাগ বহাল রাখে। সুতরাং বর্তমান মামলাটির প্রকৃত ঘটনা ও সমগ্রিক পরিস্থিতি বিচারে উল্লিখিত মামলাটির কোনো যোগসূত্র নেই।

আপিলকারীদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যায় 'অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র (criminal conspiracy)-এর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি মর্মে যুক্তির বিপরীতে আপিল বিভাগ অভিমত দিয়েছে যে, "ষড়যন্ত্র অপরাধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে একটা বেআইনি কাজ করতে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির 'মতৈক্য'। মতৈক্য অনুসারে বেআইনি কাজটি করা হতেও পারে নাও হতে পারে, তথাপি 'মতৈক্যটাই' হলো অপরাধ এবং তা শাস্তিযোগ্য। কোনো বেআইনি কাজ কিংবা বেআইনি নয় এমন কাজ বেআইনি পন্থায় করা বা করার কারণ ঘটানোর জন্য দুই বা ততোধিক ব্যক্তির স্রেফ একমত হওয়াটাই হলো 'অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র'। ষড়যন্ত্রে সহযোগিতাকারীকে অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তির সঙ্গে অপরাধকর্মে শারীরিকভাবে বা প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই, ষড়যন্ত্র অনুযায়ী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং তাতে সে যে কোনো পর্যায়ে লিপ্ত থাকলে সেটাই যথেষ্ট। 'ষড়যন্ত্র' যেহেতু গোপনে সংঘটিত হয়, সেহেতু এর প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য থাকে না। ষড়যন্ত্র প্রমাণে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়।....। আপিলকারীরা সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত/অব্যাহতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে সেনাবাহিনীর প্যারেডে সাদা পোশাকে উপস্থিত ছিল, যা থাকার কথা নয়। নাইট প্যারেডে অংশ নিয়েছিল এবং তাদের উদ্দেশ্য পূরণ ও বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পিতভাবে এই নাইট প্যারেডের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আপিলকারীরা এবং অন্য আসামিরা রক্ষীবাহিনী সদর দপ্তর, বিডিআর সদর দপ্তর, রেডিও স্টেশন, মিন্টো রোড এবং ৩২ নম্বর রোডের প্রধান প্রধান জায়গাগুলোতে কমান্ডিং অফিসারের অধীনে জওয়ান মোতায়েন করেছে। পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তর এবং বিডিআর সদর দপ্তরে এমনভাবে সেনা মোতায়েন করেছে, যেন সহযোগিতা চাইলেও রাষ্ট্রপতির সুরক্ষার জন্য এই আধাসামরিক বাহিনীগুলো এগিয়ে আসতে না পারে। রেডিও স্টেশনে সেনা মোতায়েনের উদ্দেশ্য ছিল যেন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যক্তি সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী, রাজনৈতিক কর্মী বা অন্যান্য উৎস থেকে কোনো সাহায্য চাইতে না পারে, সে কাজে বাধা দেওয়া। মিন্টো রোডে সেনা মোতায়েনের উদ্দেশ্য ছিল মন্ত্রীরাও যেন রাষ্ট্রপতিকে বাঁচানোর জন্য জনসাধারণ বা অন্য কোনো বাহিনীর কাছ থেকে সহযোগিতা চাইতে না পারে।'

আপিল বিভাগের মতে, উপরোক্ত ঘটনাসমূহ প্রমাণ করে আপিলকারীরা 'অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে'র অপরাধ সংঘটিত করেছে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যবৃন্দকে হত্যার উদ্দেশ্যে, সেনা বিদ্রোহ সংঘটিত করার জন্য নয়।

লেখকঃ বিচারপতি

সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত