শোক হোক শক্তি

1433

Published on আগস্ট 14, 2021
  • Details Image

ড. প্রণব কুমার পান্ডেঃ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনন্যসাধারণ নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছিল। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠনে অবদানের জন্য তিনি হয়ে উঠেছেন দেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বঙ্গবন্ধুর পরিপক্ক ও সাহসী নেতৃত্বের কারণেই স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল।

যতদিন বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে, স্বাধীন দেশ গঠনে তার অসামান্য অবদানের জন্য লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী তাঁকে মনে রাখবে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ঐতিহাসিক বক্তব্যে বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিল, যাতে তারা নিজেদেরকে পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্ত করতে পারে। তাঁর অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যের কারণে দেশের অসংখ্য মানুষ স্বাধীনতার জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি সচেতন ভাবে গভীর অনুভূতি দিয়ে যে কোনও রাজনৈতিক বিষয়ের গুরুত্ব বুঝতে পারতেন। আর এই জন্যই তিনি ৭ মার্চের ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা স্পষ্ট ও সরাসরিভাবে উচ্চারণ করার পরিবর্তে কূটনৈতিকভাবে বলেছিলেন, "এবারের সংগ্রাম আমদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম"। তিনি খুব ভাল ভাবেই জানতেন যে সরাসরি ভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হলে পাকিস্তানী সামরিক সরকার তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা তকমা দিয়ে বিচারের সম্মুখীন করবে। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বের কারণে ৭ মার্চ পাকিস্তানি জান্তা সরকার তাকে সঠিকভাবে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। তাদের সকল প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তারা বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেনি। তাঁর আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনার কারণে মাত্র নয় মাসের মধ্যেই আমরা স্বাধীন অর্জন করেছিলাম।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রত্যয় নিয়ে স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু করেন। তিনি যেভাবে শুরু করেছিলেন দেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে বেশি সময় লাগতো না। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কাল রাতে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের সাথে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা সেই সময় দেশের বাইরে অবস্থান করার জন্য বেঁচে যান। ঘাতকের দল শিশু রাসেলকেও হত্যা করে। আমি আজও একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজি কেন এই ঘাতকের দল শিশু রাসেলকে (যার সাথে রাজনীতির কোন সম্পর্কই ছিল না) হত্যা করেছিল? এই প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর হল ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে এতটাই ভয় পেত যে তারা তাঁর কোনো বংশধরকে জীবিত রেখে ঝুঁকি নিতে চায়নি।

বিশ্বাসঘাতকরা দেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। ১৯৭৫ পরবর্তী বিভিন্ন সরকার এই খুনিদের বিচারের সম্মুখীন করার পরিবর্তে শুধু দায়মুক্তিই দেয়নি বরং খুনিদের বিভিন্ন ভাবে পুরস্কৃত করেছিল। চক্রান্তকারীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিশ্বাসঘাতক যে কয়জন নেতা ছিল তারা প্রায় সকলেই বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিভিন্ন সুবিধা-সুবিধা নিয়েছিল। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর অধ্যায় মুছে ফেলা। এদের মধ্যে অনেকে সব কিছু জেনে না জানার ভান করে এই হত্যা কাণ্ডের সব চেয়ে বড় সুবিধাভোগী হয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীরা কল্পনাও করে নি যে, বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশে ফিরে একদিন ক্ষমতায় বসে তাদের বিচার করবে। এর এই কারণেই ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন সরকার ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানায়নি।

হত্যাকারীরা কখনো ভাবেনি যে, বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে সামরিক শাসকদের নিষ্পেষণে নিষ্পেষিত ভঙ্গুর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে শুধু ভঙ্গুর দলকেই সংগঠিত করেন নি বরং সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের (যারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ২১ বছর ধরে সুরক্ষিত ছিল) বিচারের আইনি প্রক্রিয়াও শুরু করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সরকারের আইনি পদক্ষেপ অব্যাহত রাখা আমাদের জন্য একটি আনন্দদায়ক মুহূর্ত ছিল। কিন্তু এটা অত্যন্ত হতাশাব্যাঞ্জক যে ২০০১ আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হলে খুনিদের বিচারের প্রক্রিয়া পুনরায় বন্ধ হয়ে যায়। ২০০১ সালের সরকার খুনিদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করেই ক্ষান্ত হয়েছিল না তারা বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে মুছে ফেলার সকল চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করেন এবং পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুর অবদানের বাস্তব ইতিহাস প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে (যা পূর্ববর্তী সরকার মুছে দিয়েছিল) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস রচনা করেন।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে, সব ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁসি দেওয়া যায়নি কারণ কেউ কেউ বিভিন্ন দেশে লুকিয়ে আছে। অতএব, সরকারের উচিত আদালতের রায় কার্যকর করতে পলাতক আসামীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এই পলাতক খুনিদের রায় কার্যকর করার মাধ্যমে জাতি হিসেবে আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারব।

অনেকেই প্রশ্ন করেন যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৫ আগস্টের (যে দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো দিন হিসেবে বিবেচিত হয়) প্রভাব কি ছিল? বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে এই খুনিরা দেশের গণতন্ত্রকে একদিকে যেমন হত্যা করেছিল, অন্যদিকে দেশের উন্নয়নের গতিপথ বিপরীত দিকে ধাবিত করেছিল কারণ ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্যতা নিশ্চিত করার সম্ভব হয় নি। আমরা সকলেই জানি যে রাজনৈতিকভাবে আমাদের দেশ দুটি ধারায় বিভক্ত। এই বিষয়ে অবাক হবার কিছু নেই কারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বহুমত থাকবেই। তবুও, রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও, দেশের জনগণকে কিছু বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছাতে হয়। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই ঘটনাগুলোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ অন্যতম। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৫ আগস্ট এমন একটি ঘটনা যেখানে রাজনৈতিক মতপার্থক্য নির্বিশেষে সকলেরই সম্মান করা উচিত।

আমাদের সকলের ঐকমতে পৌঁছাতে হবে এই মর্মে যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মত নৃশংসতা আমাদের দেশে যেন আর কখনই না ঘটে। পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আমরা কী হারিয়েছি তা এখনো অনেকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন উপলব্ধি করতে পারেন নৃশংসভাবে স্বজন হারানোর কি জ্বালা। অতএব, আমাদের সকলের উচিত ১৫ আগস্টের জাতীয় ট্র্যাজেডির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। এই দিবসটির প্রতি সম্মান জানানোর দায়িত্ব বঙ্গবন্ধুর পরিবার বা আওয়ামী লীগের নয়। প্রত্যেক গর্বিত বাংলাদেশীর উচিত এই দিনে শোক পালন করা এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা কারণ এটি একটি জাতীয় বিপর্যয় ছিল।

এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় এবং সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। আমাদের সকলের উচিত শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে একটি স্বাধীন ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় সাহায্য করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও ১৫ আগস্টের শহীদের প্রতি সম্মান জানানো। বঙ্গবন্ধু এমন একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যেখানে স্বাধীনতার চেতনা সংরক্ষিত থাকবে এবং সকল জাতি ও বিশ্বাসের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে।

বঙ্গবন্ধুর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাবার অসমাপ্ত স্বপ্ন "সোনার বাংলা" প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এই লক্ষ্য অর্জনে আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। ১৫ আগস্টের বর্বরতা থেকে আমরা একটি শিক্ষা পেয়েছি যে একজন নেতাকে হত্যা করে তাঁর অবদান দেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায় না। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাজনীতির একজন জ্বলন্ত নক্ষত্র। যতদিন বাংলাদেশ বিশ্বে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে, বঙ্গবন্ধু ততদিন তাঁর অবদান, আদর্শ এবং মূল্যবোধের মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে ।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর

সৌজন্যেঃ jagonews24.com

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত