বঙ্গবন্ধু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

3168

Published on জুলাই 1, 2021
  • Details Image

অজয় দাশগুপ্তঃ

রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার করে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই, ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে। যুক্ত থাকেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমি ঢাকায় এলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, আইন পড়ব। বই পুস্তক কিছু কিনলাম।’ [পৃষ্ঠা ৮৭]

কলিকাতা থেকে বিএ পাস করে ঢাকায় আসার চার মাসের মধ্যে (১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি) তিনি গঠন করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। প্রথম আনুষ্ঠানিক সভা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে। মাত্র দুই মাস পরেই এ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা প্রথম ভাষা আন্দোলনে (১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে হরতাল ডাকা হয়েছিল) সামনের সারিতে চলে আসেন। বঙ্গবন্ধু হাইকোর্ট-কার্জন হল এলাকায় হরতাল পালন করতে গিয়ে গ্রেফতার হন। ছাত্রলীগ গঠন ও ভাষা আন্দোলনে যাদের সঙ্গে পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন নইমউদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, মোল্লা জালালউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, দবিরুল ইসলাম প্রমুখ। অলি আহাদ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে সাম্প্রদায়িক সংগঠন হিসেবে গন্য করেন এবং এতে যুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এ সংগঠনের ব্যানারেই অসাম্প্রদায়িক আদর্শের ভিত্তিতে ছাত্রসমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলায় সফল হন, যা কালক্রমে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বর্ষাফলকে পরিণত হয়। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার দেড় বছর যেতে না যেতেই প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ, কারাগারে থেকেও বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রাণপুরুষ। এ দলটিও বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য নেতা-কর্মীর প্রেরণায় ১৯৫৫ সালে পরিণত হয় অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার হওয়ার পরেই তিনি বুঝতে পারেন- বাঙালিদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তিনি পরিত্রাণের পথ অনুসন্ধান করতে থাকেন এবং এ ক্ষেত্রে ছাত্রসমাজের ভূমিকা উপলব্ধি করেন। ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি খ্যাতিমান সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো?’ উত্তর এসেছিল- ‘সেই ১৯৪৭ সালে। ... একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলা ভাষা। আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে। ভাষাভিত্তিক আন্দোলনই একটু একটু করে রূপ দিই দেশভিত্তিক আন্দোলনে।... তারপর স্লোগান দিই জয় বাংলা।’

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময়ে পূর্ব বাংলায় প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছিল সীমিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হতো, ঢাকা শহর শুধু নয় গোটা ভূখণ্ডেই তাদের বিশেষ প্রভাব ও সম্মান। ঢাকার ছাত্ররা কোনো দাবি সামনে নিয়ে এলে তা আদায়ের আন্দালনের কেন্দ্র হতো পুরাতন কলাভবনের (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ বার্ন ইউনিট এলাকা) আমতলা ও মধুর ক্যান্টিন। 

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের আন্দোলনের এক বছর পর বঙ্গবন্ধুর সামনে আরেকটি বড় উপলক্ষ আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভুক কর্মচারীরা বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘট ডাকলে ছাত্রলীগ তাদের পাশে দাঁড়ায়। কঠিন পরিশ্রম, সাংগঠনিক দক্ষতা, মনোমুদ্ধকর বক্তৃতা ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কারণে বঙ্গবন্ধু তখন ছাত্রলীগের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট করায় তিনিসহ ২৭ জন ছাত্রনেতা কর্তৃপক্ষের রোষের শিকার হন। তাকে ১৫ টাকা জরিমানা করা হয়, যা দিতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। বলা হয়, দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে শাস্তি প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু তিনি আন্দোলনের পথ বেছে নেন। উপাচার্য ড. মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসভবনে অবস্থান  শুরু করেন নিম্নবেতনভোগী কর্মচারীদের পক্ষে। উপাচার্য পুলিশ ডাকেন। নির্ভীক শেখ মুজিবুর রহমানকে পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বন্ড দিয়ে মুক্তির কথা বলা হলে তিনি অসম্মত হন। অথচ শাস্তিপ্রাপ্ত অন্য সকলে বন্ড দিয়ে নতিস্বীকার করে। 

এ ঘটনার ২৩ বছর পর ১৯৭২ সালের ২০ জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের অফিসে দেখি ভিন্নরূপে। তখন তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতির পিতা। তাঁর আহ্বানেই এক বছরের কিছু আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু এবং ছাত্রলীগের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কলাভবনের সামনের বটতলায় উত্তোলন করেছিল বাংলাদেশের পতাকা। দুই যুগের নিরস্ত্র, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন পরিণত হয় সশস্ত্র সংগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দু’শ ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও কর্মচারী আত্মাহুতি দেন। স্বাধীনতার পর ৬ মে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক সমাবেশে ভাষণ দেন। তাকে ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ প্রদান করা হয়। তিনি ছাত্রদের লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে আহ্বান জানিয়ে বলেন, দখলদার বাহিনী শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের হত্যা করেছে। এ সব মনীষির শূন্যস্থান ছাত্রদেরই পূরণ করতে হবে। এ সময় তাকে ১৯৪৯ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কারের আদেশের অনুলিপি প্রদান করা হয় [কেন সে সময় এই অন্যায় আদেশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি, সে প্রশ্ন উঠতে পারে। এটা করা হয় তাঁর বহিষ্কারের ৬১  বছর পর, ২০১০ সালের ১৪ আগস্ট]।

বঙ্গবন্ধু ২০ জুলাই (১৯৭২) উপাচার্যের অফিসে এসেছিলেন একদল শিক্ষার্থীর অন্যায় ও অপরিণামদর্শী আচরণের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করতে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী উপাচার্যসহ কয়েকজন বরেণ্য শিক্ষককে অবরোধ করে রেখেছিল পরীক্ষা গ্রহণ ছাড়াই পাস করিয়ে দেওয়ার দাবিতে। উপাচার্য অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী পুলিশ ডাকেননি। বঙ্গবন্ধুর কাছে অবরোধের খবর যায়। তিনিও পুলিশকে ছাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হুকুম দেননি। নিজে ছুটে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অটোপ্রমোশনের অন্যায় দাবি তোলার জন্য শিক্ষার্থীদের ভৎর্সনা করেন। শিক্ষকদের অসম্মান করার জন্য প্রকাশ করেন তীব্র ক্ষোভ। পরদিন ছিল সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে ছাত্রলীগের সমাবেশ। সেখানে তিনি বিনা পরীক্ষায় পাসসহ যে কোনো অন্যায় দাবির প্রতি আপসহীন থাকার জন্য ছাত্র সংগঠনের সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান। [অটোপ্রমোশনের মতো আত্মঘাতী দাবির বিরোধিতা করতে গিয়ে সে সময় ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মাহবুবজামান  এবং এ নিবন্ধের লেখক (অজয় দাশগুপ্ত) বটতলায় একদল ছাত্রনামধারীর হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন]

স্বাধীনতার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠ উপহার ছিল বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩। এর আওতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পেয়ে যায়। পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যায় সিদ্ধান্তের কারণে তাঁর ছাত্রজীবনের ইতি ঘটে। কিন্তু তিনি যে জীবনের পাঠ গ্রহণ করেছেন। বিশ্বজুড়েই যে তাঁর পাঠশালা। পাকিস্তানে টু ইকোনমি তত্ত্বের জন্য সুপরিচিত অধ্যাপক রেহমান সোবহান আমাকে বলেছেন- ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বসলে মনে হতো হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষকের কথা শুনছি।’  শিক্ষার প্রসার ও গবেষণায় নিবেদনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনভাবে কাজ করা প্রয়োজন, এটা বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করতেন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য তিনি ১৯৭৩ সালের আইনের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সংস্থা হিসেবে সিনেট গঠন করেন। শিক্ষক এবং সাবেক ও বর্তমান ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব এ সংস্থায় নিশ্চিত হয়।

বঙ্গবন্ধু যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য ড. কুদরাত-ই-খুদাকে প্রধান করে শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। তাদের প্রতিবেদনে উচ্চশিক্ষা সুযোগ নয়, বরং সবার সমান অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হয়।

১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ছাত্র হিসেবে না হলেও আবার ফিরে আসব।’ [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  ও বাংলাদেশের জন্ম- কাজী আহমেদ কামাল, পৃষ্ঠা ৩৯]

দুই মাসের বেশি জেলে থেকে তিনি ফিরে এসেছিলেন ১৯৪৯ সালের ২৬ জুন। এর তিন দিন আগে প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। জেলে থাকলেও তাকে জয়েন্ট সেক্রেটারির দায়িত্ব প্রদান করা হয়। মুক্তির পর তাকে জেল গেটে বরণ করার জন্য ব্যান্ড পার্টি নিয়ে হাজির ছিলেন সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি ও সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। বিশাল মিছিল নিয়ে মওলানা ভাসানী দলের তরুণ নেতাসহ হাজির হন ঐতিহাসিক আমতলায়, তিন বছর যেতে না যেতেই যে স্থান থেকে ছাত্রদের মিছিল বের হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। দলের সহসভাপতি ও পরে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান বলেছেন, ‘সে দিন কার্যত আওয়ামী লীগের যুবরাজের অভিষেক সম্পন্ন হয়ে গেল।’

১৯৪৯ সালের শেষ দিনে বঙ্গবন্ধু ফের গ্রেফতার হন। এ বন্দিজীবন চলে প্রায়  ২৬ মাস। ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কেবিনে চিকিৎসাধীন, কাটাচ্ছেন বন্দিজীবন। কেবিনে বসেই তিনি ছাত্রনেতাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে ২১ ফেব্রুয়ারি হরতালের কর্মসূচি চূড়ান্ত করেন। এ কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নিজে সিদ্ধান্ত নেন অনশন করার।

যে প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃত্ব দেয় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। সৃষ্টি হয় ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির অমর বীরত্বগাঁথা। এ ঐতিহাসিক ঘটনার মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন চ্যালেঞ্জ করে। ১৯৬২ সালের এই আন্দোলনে উৎসাহ ও সহায়তা প্রদানের অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে নির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে তিনি হাজির থাকেন শহীদ বরকতের মায়ের সঙ্গে। এ মহতী অনুষ্ঠানে বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সঙ্গে হাজির ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি স্বায়ত্তশাসনের ৬-দফা কর্মসূচি প্রদানের পর বঙ্গবন্ধুর প্রতি বলিষ্ঠ সমর্থন আসে ছাত্রলীগ থেকে। এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশিরভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। তারা ৬-দফার পক্ষে জনমত গঠনের কাজ শুরু করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, অর্থনীতির অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ও রেহমান সোবহান, পদার্থবিদ্যা বিভাগের ড. আবদুল মতিন চৌধুরীসহ একদল শিক্ষককেও তিনি পাশে পান। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হলে ১৯৬৯ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) উদ্যোগী হয়ে এ ভূখণ্ডের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে ছাত্র-গণ অভ্যুত্থান সৃষ্টি করে, যার পরিণতিতে ষড়যন্ত্র মামলা বাতিল হয়ে যায়, তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে সকলের কাছে সমাদৃত হন।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এর দুদিন বাদেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ ও কলাভবন প্রাঙ্গনে ছাত্রছাত্রীরা শুরু করে দেয় সামরিক প্রশিক্ষণ। লক্ষ্য স্পষ্ট- বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জেনোসাইডের অন্যতম প্রধান টার্গেট কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছিল, আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না।  

১৯৭৫ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেন। ২১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির বেশিরভাগ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। ১৫ আগস্ট জাতির পিতা, রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে আসার কথা ছিল। তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এ প্রতিষ্ঠানের অনন্য অবদান জানতেন। বাংলাদেশকে উন্নত ও গর্বিত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা তথা সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তাঁর প্রত্যাশা ব্যক্ত করবেন, এমন ধারণা ছিল আমাদের। কিন্তু দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে এ দিন প্রত্যুষে তিনি নিহত হন। রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে যায় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসমাজ দমে যায়নি। ক্ষোভ-প্রতিবাদে তারা গর্জে ওঠে। জাতীয় ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসের দেয়াল ভরে ফেলে ‘নিষিদ্ধ স্লোগান’ জয় বাংলা ও জয় বঙ্গবন্ধু এবং এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে লিখে। ৪ নভেম্বর (১৯৭৫) ঐতিহাসিক বটতলা থেকে শোক মিছিল যায় ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে। ঘাতকরা হুমকি দিয়েছিল বটতলা থেকে এক পা বাইরে বাড়ালেই ব্রাশ ফায়ারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে। কিন্তু ছাত্রসমাজ সেটা উপেক্ষা করে। ওই দিনেই জাতির পিতা, রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চ্যান্সেলর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার নিন্দা ও শোকপ্রকাশ করে সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ফোরাম সিনেটে। এই মহান বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্র ইসমত কাদির গামা, মাহবুব জামান ও অজয় দাশগুপ্ত (এ নিবন্ধের লেখক) সিনেট সদস্য হিসেবে এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের শতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ এই অনন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত সকলের প্রতি জানাই কুর্নিশ। আমাদের প্রিয় এ প্রতিষ্ঠান কেবল ঐতিহ্যের স্মৃতিচারণ নয়, নব নব অর্জনে সমৃদ্ধির শিখরে নিয়ে যাবে এ প্রতিষ্ঠানের এক সময়ের ছাত্র জাতির পিতা  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশকে- এটাই প্রত্যাশা।

লেখকঃ একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত