বঙ্গবন্ধু একাত্তরের মার্চেই বিকল্প সরকার পরিচালনা করেন

2941

Published on মার্চ 2, 2022
  • Details Image

অজয় দাশগুপ্তঃ

বাংলাদেশ কেবল স্বাধীনতা  অর্জন নয়, প্রশাসন পরিচালনা, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার জন্যও যে প্রস্তুত, সেটা স্পষ্ট হয়ে যায় ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাছারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালেল জন্য বন্ধ থাকবে। ...সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দপ্তর, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন।... যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হচ্ছে ততদিন খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না।’

লক্ষণীয় যে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে পূর্ব পাকিস্তান নয়, ‘বাংলাদেশ’ বলেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ১ মার্চ থেকেই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পাকিস্তান সরকার কিংবা মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষের কোনো নির্দেশ কার্যকর হচ্ছিল না। জেলা, মহকুমা ও থানা প্রশাসন এবং পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী (গোয়েন্দা বিভাগসহ) চলছিল ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়ক থেকে আসা নির্দেশ মোতাবেক। সচিবালয়ের কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করার অঙ্গীকার করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের শীর্ষ অফিসার এবং ব্যবসায়ীদের সংগঠনের নেতারাও একই পথে চলতে থাকেনন্মনে রাখতে  হবে, সে সময় প্রতিদিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অসংখ্য মিছিল আসত এবং বঙ্গবন্ধু বাড়ির ব্যালকনি ও গেটে এসে জনগণের সঙ্গে দেখা করতেন, বক্তব্য রাখতেন। রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারাও আসতেন। ১৬ মার্চ থেকে শুরু হয় ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন ১৫ মার্চ। বঙ্গবন্ধু তাকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নয়, ‘বাংলাদেশের অতিথি বা গেস্ট’ হিসেবে বর্ণনা করেন। সে সময় পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর ঢাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালেক তাঁর ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ইয়াহিয়া ঢাকা বিমানবন্দর থেকে প্রেসিডেন্ট হাউসে কীভাবে যাবেন সেটা নিয়ে আলোচনার সময় ঢাকার বাঙালি পুলিশ সুপার আনন্দের সংবাদ দেন যে শেখ সাহেব To avoid embarrassment to his guest, ফার্মগেট চেকপোস্ট অপসারণে সদয়সম্মতি প্রদর্শন করেছেন।’ [পৃষ্ঠা ৫৯]

আমরা জানি, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অতিথি আসেন ভিন্ন রাষ্ট্র থেকে কোনো স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানকে ভিন্ন রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবেই গণ্য করেন।

ইয়াহিয়া খানের ঢাকায় আসার প্রাক্কালে সামরিক কর্তৃপক্ষ এমএলআর ১১৫ জারি করে অনুপস্থিত সকল সরকারি অফিসার ও কর্মচারীকে ১৫ মার্চের মধ্যে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে হাজির হওয়ার নির্দেশ প্রদান করে। অন্যথায় কোর্ট মার্শাল করে কঠোর শাস্তি প্রদানের হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু কেউ এ নির্দেশ পালন করেনি। ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সর্বত্র বাংলাদেশ-এর পতাকা উত্তোলনের আহ্বান জানালে তা পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর গাড়িতে এ পতাকা লাগিয়েই ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন।

অন্যদিকে, ১৫ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলনের নয়া নির্দেশাবলী ঘোষণা করা হয় বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে, যা ততদিনে ‘বাংলাদেশ-এর সচিবালয়ে’ পরিণত হয়েছে। এতে ছিল ৩৫টি নির্দেশ, যার প্রথমটি ছিল সরকারী সংস্থাসমূহের প্রতি, যাতে বলা হয়- 'নিম্নে বর্ণিত বিশেষ নির্দেশাবলী এবং বিভিন্ন সময়ে যে সব ছাড় ও ব্যাখ্যা দেওয়া হবে তা সবাই মেনে চলবেন’। তিন নম্বর নির্দেশ ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা সংক্রান্ত, যাতে বলা হয় পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে এবং প্রয়োজনবোধে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সাথে যোগ দেবে। বন্দর, আমদানি বাণিজ্য, সড়ক ও রেলওয়ে, ডাক বিভাগ ও টেলিফোন বিভাগকে ৭ মার্চ থেকেই হরতালের আওতামুক্ত ঘোষণা করা হয়। অসহযোগ আন্দোলনের সময় এ সব প্রতিষ্ঠান কীভাবে কাজ করবে সেটা ৪ থেকে ১০ নম্বর নির্দেশে স্পষ্ট  করে বলা হয়।

১১ নম্বর নির্দেশে বলা হয়, বেতার- টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে গণআন্দোলন সম্পর্কিত বক্তব্য-বিবৃতি-সংবাদ প্রচার করা হবে। হাসপাতাল, বিদ্যুৎ বিভাগ, গ্যাস ও পানি সরবরাহ বিভাগগুলো কীভাবে কাজ করবে সেটা স্পষ্ট করার পাশাপাশি কৃষি খাত, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নির্মাণ কাজ যেন সচল থাকে সে জন্যও নির্দেশনা দেওয়া হয়। ২৫ ও ২৬ নম্বর নির্দেশ ছিল ব্যাংকিং কার্যক্রম সংক্রান্ত। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেভাবে কাজ করে, অসহযোগ আন্দোলনের সময় আমরা সেই ভূমিকাই পালন করতে দেখি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত ‘বিকল্প প্রশাসনকে’। ৩১ নম্বর নির্দেশে বলা হয়- কোনো খাজনা-ট্যাক্স আদায় করা যাবে না। তবে প্রাদেশিক সরকারের কর আদায় করা যাবে এবং ‘বাংলাদেশ সরকারের অ্যাকাউন্টে তা জমা দিতে হবে।’ এতে স্পষ্ট করে দেওয়া হয় যে কেন্দ্রীয় সরকারের পরোক্ষ কর আদায় করলেও তা কেন্দ্রীয় সরকারকে না দিয়ে ‘বাঙালি মালিকানাধীন ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন অথবা ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকে বিশেষ অ্যাকাউন্ট খুলে জমা করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের সকল প্রত্যক্ষ কর (যেমন  আয়কর) আদায় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।

খ্যাতিমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. জিল্লুর রহমান খান তাঁর ‘বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্ব ও স্বাধীনতা সংগ্রাম’ গ্রন্থে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন বিশ্বের একমাত্র নেতা যিনি অসহযোগ আন্দোলনের  মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি লোকের জন্য একটি ডি-ফ্যাক্টো বা কার্যত সরকার গঠন করেছিলেন (মহাত্মা গান্ধী ও মার্টন লুথার কিং ডি-ফ্যাক্টো সরকার গঠন করেননি)।...তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় এমন একজন অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন, যিনি যা চাইতেন জনগণ সেটাই করত। [পৃষ্ঠা ১৩-১৪]

খাজনা-ট্যাক্স সংক্রান্ত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ প্রতিটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। ড. জিল্লুর রহমান খান ওই গ্রন্থে আরও লিখেছেন, ‘এ সময়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একটি পয়সাও কর প্রদান করেনি এবং কোনো প্রতিষ্ঠান তা করারও সাহস দেখায়নি। এমনকি ঢাকার দুই অভিজাত হোটেলও (ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও পূর্বানী) হোটেল ও বিনোদন কর আদায় বন্ধ করে দিলে সেখানের খাদ্যদ্রব্যের মূল্য এত কমে যায় যে মধ্যবিত্তরাও সেখানে খেতে পারে। শেখ মুজিবুর রহমান পরবর্তী সময়ে নো-ট্যাক্স নির্দেশ সংশোধন করেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো  বিভাগের পরিবর্তে বাঙালি মালিকানাধীন দুটি ব্যাংকে কর জমা দিতে বলেন এবং শিল্পপণ্য উৎপাদক, বিক্রেতা ও আমদানিকারকরা সে নির্দেশ পালন করে।’ [পৃষ্ঠা ১২০-১২১]

প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের সেই অগ্নিঝরা আন্দোলনের দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর বিকল্প সরকার প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনাতেও অনন্য দক্ষতা প্রদর্শন করে। এই অভিজ্ঞতা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার (১৭ এপ্রিল মুজিব নগরে এ সরকার শপথগ্রহণ করে) যথাযথভাবে কাজে লাগাতে  পারে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার অনেক আগেই জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, কৃষি-শিল্প-বাণিজ্যসহ আর্থ-সামাজিক নীতি, পররাষ্ট্র নীতি- এ ধরনের অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত এবং নীতি-কর্মপন্থা চূড়ান্ত করার কাজে বঙ্গবন্ধু ছিলেন উদ্যোগী। নিষ্ঠুর গণহত্যার সময়ে গঠিত বাংলাদেশ সরকার প্রথম দিন থেকেই যেভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকে তাতেও গোটা বিশ্ব বুঝে যায়- বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত। গোটা বাংলাদেশ ভূখণ্ড যখন বধ্যভূমি, এমন পরিবেশেই আমাদের সরকার লাখ লাখ ছাত্র-যুবককে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ প্রদান ও অস্ত্রসজ্জিত করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের নাকাল করেছে, শত্রুকে বাধ্য করেছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পনে। পরিকল্পনা কমিশনের আদলে সেল গঠিত হয়েছে। নিজস্ব শিল্পী-কলাকুশলী দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্র পরিচালনা করেছে। এক বছর শত্রুর দুর্গে বন্দি থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি নিজের আজন্মলালিত স্বপ্নসাধ পূরণ হওয়া মুক্ত বাংলাদেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই তাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্র বিনির্মাণে মনোনিবেশ করতে পেরেছেন। জনগণও বাংলাদেশের স্থপতির দিকনির্দেশনার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়েই ছিল। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর সরকার পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের কঠিন দায়িত্ব পালনে যে দক্ষতা প্রদর্শন করে তার ভিতর তিনিই ১৯৭১ সালের মার্চ মাসেই রচনা করেছিলেন।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা,  একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত