জিয়ার ‘বীর উত্তম’ খেতাব প্রত্যাহার বিতর্ক যে কারণে রাজনৈতিক নয়

3811

Published on ফেব্রুয়ারি 15, 2021
  • Details Image

সুলতান মির্জাঃ

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক জেনারেল জিয়াউর রহমান যদি ইতিহাসের মহানায়ক হয়ে থাকেন তাহলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা নেই জিয়াউর রহমানকে খলনায়ক বানানোর। অপরদিকে জিয়াউর রহমান যদি ইতিহাসের খলনায়ক হয়ে থাকেন তাহলে বিএনপি-জামায়াত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ঐক্যজোট- কারোই ক্ষমতা নেই তাকে মহানায়ক বানানোর। ইতিহাস তার নিজ গতিতেই চলমান।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের পরে এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত মনগড়া ইতিহাস যেমন রচিত হয়েছে, পাশাপাশি বিকৃত ইতিহাস রচনাকারীদের ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের ইতিহাসও রচিত হয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বিভিন্ন বিতর্কিত কাজের ভিত্তিতে একটি প্রস্তাবনা এনেছে মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার প্রাপ্ত বীরউত্তম খেতাব প্রত্যাহারের। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হিসেবে জিয়াউর রহমান কিভাবে খেতাব পেয়েছেন সেটা আলাদা আলোচনার বিষয়। তবে রাষ্ট্র কাউকে কোনও কিছু দিয়ে সম্মানীত করলে, পরবর্তিতে সম্মানীত ব্যক্তি যদি তার কর্ম দিয়ে সম্মান রক্ষা করতে না পারেন, তাহলে রাষ্ট্র সে সম্মান ফিরিয়ে নিতে পারে।

এমতাবস্থায় জেনারেল জিয়াউর রহমান কেমন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, কেমন যুদ্ধ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে তার মনোভাব কী ছিল, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যায় খুনি কর্নেল ফারুকের দেওয়া জবানবন্দিতে জেনারেল জিয়ার জড়িত থাকা- এসব মোটেও আলোচ্য বিষয় নয়। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল জিয়াউর রহমানের ‘বীর উত্তম’ খেতাব প্রত্যাহারের জন্য চারটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ চিহ্নিত করেছে। অভিযোগগুলো হচ্ছে—

১. সংবিধান লঙ্ঘন,

২. সংবিধানের মূলনীতি বাতিল,

৩. স্বাধীনতাবিরোধী লোকজন নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন,

৪. বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশত্যাগে সহায়তা করা।

জিয়ার সংবিধান লঙ্ঘন ও সংবিধানের মূলনীতি বাতিল

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসন জারি করে তৎকালীন জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধানের যেসব আইন বাতিল করেছিল-

১. ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর Ordinance No 63 of 1975 এর মাধ্যমে ‘দালাল আইন’ বাতিল করা।

২. ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর second proclamation order No 3 of 1975 প্রথম তফসিল থেকে দালাল আইনের যে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছিল তা বাতিল।

৩. ১৯৭৬ সালে second proclamation order No 3 of 1976 এর মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তনের জন্য ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাদি রহিতকরণ।

৪. ১৯৭৭ সালে proclamation order No 1 of 1977 জারি করে সংসদে আলবদরদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের কিছু অংশ রহিতকরণ।

৫. ১৯৭৬ সালের ১৮ জানুয়ারি যাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, নাগরিকত্ব ফেরত পাওয়ার জন্য তাদের আবেদনের অনুরোধ।

৬. ১৯৭৭ সালে proclamation order No 1 of 1977 দ্বারা সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ রহিতকরণ।

অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে জেনারেল জিয়া সামরিক শাসন জারি করে যে কাজগুলো করেছিলেন তা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সম্পূর্ণ বিপরীত মতাদর্শের ও বাংলাদেশের সংবিধান বিরোধী। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার আলবদররাও একই কাজ করছিল। জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর সাহায্যে ক্ষমতা দখল করে প্রথম সংবিধান সংশোধন করেছিলেন । বাংলাদেশে সংবিধানের ওপর প্রথম হামলাকারী দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন জেনারেল এরশাদ। উভয় সামরিক শাসক বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার আলবদররা যেমন খুনের রাজনীতি করেছে জেনারেল জিয়াও তেমন খুনের রাজনীতি করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের পরে দালাল আইনে যারা দণ্ড ভোগ করছিল, জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে তাদের সসম্মানে মুক্তি দিয়েছিলেন।মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে অবস্থা নির্ণয়ে যেসব রাজাকার-আলবদর-দালালেরা পাকিস্থানে গিয়েছিল, জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনের কল্যাণে নেতৃস্থানীয় আলবদররা পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা শুরু করল। সৌদি আরব থেকে এসেছিল রাজাকার ও আলবদরের শীর্ষ দালাল গোলাম আযম ।

জিয়াউর রহমানের এসব সংশোধনী আলবদর ও রাজাকারদের এত খুশি করেছিল যে, ‘বামপন্থী’ নেতা কাজী জাফর আহমদ যিনি পরে জিয়ার দলে এবং আরও পরে এরশাদের দলে যোগ দিয়ে বিভিন্ন সময় সিভিল সমাজের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, তিনি পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘‘মওলানা সিদ্দিক [স্বাধীনতাবিরোধী] বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করার যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন তার সুযোগ সরকারই করে দিয়েছেন। সংবিধানের ৩৮ ধারা বাতিলের ফলেই এরা রাজনীতিতে আসতে পেরেছে।… এরা জাতি ও গণস্বার্থবিরোধী… সংবিধানের ৩৮ ধারা বাতিল করে এ সকল জাতীয় দুশমনকে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করার সুযোগ দেওয়া একটি অন্তর্বতীকালীন সরকারের উচিত হয়নি।’’ [দৈনিক সংবাদ, ৪.১১.১৯৭৬]

বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে সুসংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান।

পাকিস্তানফেরত সামরিক অফিসারদের ইচ্ছানুসারে জেনারেল জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন করেছিলেন। বহু রাজনৈতিক দল থেকে লোক এনে বিএনপি গঠন করা হয়েছিল। জেনারেল জিয়া ক্ষমতা দখল করে যে দল গঠন করেছিল, দলটিতে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ ব্যক্তিদের সমাবেশ হয়েছিল বেশি। শাহ আজিজ, মশিউর রহমান, আব্দুর রহমান বিশ্বাস, বিচারপতি আব্দুস ছাত্তার, আব্দুল আলিমসহ বিএনপি গঠনকালীন যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন- তারা সবাই ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষের লোক। দালাল আইনে বিচারপতি ছাত্তার ছাড়া সবাই কারাগারে ছিলেন। তবে বিএনপির গঠনকালীন মহাসচিব ডা. বদরুদোজ্জা চৌধুরী দালালও ছিলেন না, আবার মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন না।

জিয়াউর রহমান ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়েই মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ১৯৭৫-এর নভেম্বরের পরে যখন তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন তখন তিনি আওয়ামী লীগবিরোধী সব এলিমেন্টস জড়ো করেছিলেন তার রাজনৈতিক স্বার্থে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ করেছেন, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’কে তার জায়গায় প্রতিস্থাপন করেছেন।

দেশবিরোধী রাজাকার-আলবদর-আলশামস যুদ্ধাপরাধীদেরকে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেন জিয়া। বঙ্গবন্ধু রাজাকারদের বিচার শুরু করেছিলেন, দুই বছরের মধ্যে ৭৮০ জনেরও বেশি দালালকে দণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সে সময় নিজামী-মুজাহিদদের মতো ওপর দিকের পরিকল্পক ও খুনিরা পাকিস্তানে পালিয়ে ছিলেন। জিয়া পলাতক অবস্থায় থাকা সব যুদ্ধাপরাধীকে দেশে আসার সুযোগ করে দেন। এ খুনিদের যদি পুনর্বাসন না করা হত, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতি এত কলুষিত হত না। খুনি সমর্থক এসব রাজনীতিবিদের উত্থান হত না। বাংলাদেশ এখন বিভক্ত হত না মানসিক দিক থেকে, কিন্তু জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন দেশটিকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে।

’রাজাকার আলবদররা ১৯৭১ সালে খুনের পর খুন করেছিল। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে তাদের অপরাধ শুধু মাফ করা নয়, তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দিলেন! যেসব আলবদর ঘাপটি মেরে বসেছিল তারা প্রকাশ্যে বেরিয়ে জামায়াতকে সংঘটিত করতে লাগল। ছাত্রশিবির বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে স্বাধীনতাপক্ষের ছাত্রদের রগ কাটতে লাগল। রাষ্ট্রে জামায়াতের রাজনীতি ‘রগকাটা রাজনীতি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে গেল। জিয়া রাজাকার, আলবদরদের- সচিব, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ করলেন। এক কথায় জেনারেল জিয়াই আল বদর, রাজাকারদের শুধু ক্ষমা নয়, ঘরের ভেতর আশ্রয় দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের জাতীয় বীর বানিয়ে বিদেশে পুনর্বাসন করা

১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকারীদের এক রকম জাতীর বীর ঘোষণা দিয়ে খুনিদের রক্ষা করতে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধে খন্দকার মোশতাক যে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিলো, জিয়াউর রহমান সেটিকে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের অংশ করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষায় জেনারেল জিয়া সারা বিশ্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে খুনিদের চাকরি দিয়ে পুনর্বাসন প্রকল্প শুরু করেন।

১৯৭৬ সালের ৮ জুন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকার দায়ে অভিযুক্ত হত্যাকারীদের ১২ জনকে ১. লে. কর্নেল শরিফুল হককে (ডালিম) চীনে প্রথম সচিব, ২. লে. কর্নেল আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব, ৩. মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব, ৪. মেজর বজলুল হুদাকে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব, ৫. মেজর শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব, ৬. মেজর রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব, ৭. মেজর নূর চৌধুরীকে ইরানে দ্বিতীয় সচিব, ৮. মেজর শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব, ৯. ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেমকে আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব, ১০. লে. খায়রুজ্জামানকে মিসরে তৃতীয় সচিব, ১১. লে. নাজমুল হোসেনকে কানাডায় তৃতীয় সচিব, ১২. লে. আবদুল মাজেদকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে সাহায্য করেছেন তৎকালীন শাসক সামরিক জান্তা জেনারেল জিয়াউর রহমান। খুনিদের এভাবে পুরস্কৃত করার ঘটনা ছিল বিশ্বে নজিরবিহীন।

উপরের লিখিত ঘটনাগুলো একাধিক প্রত্যক্ষ ইতিহাসবিদের জবানবন্দি থেকে প্রাপ্ত সারসংক্ষেপ, যারা মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতির উপরে আস্থা রেখে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছেন। লেখার শুরুতেই বলেছি, জেনারেল জিয়াউর রহমান কেমন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বা না ছিলেন এসব নিয়ে আলোচনা করবো না। জিয়ার বীর উত্তম খেতাব প্রত্যাহারের কারণগুলোর মধ্যে তা আলোচ্য নয়।

কিন্তু আলোচ্য কারণগুলো ও তার সংক্ষেপ বিবরণে, শুধু একটা প্রশ্নই করবো, ধরে নিলাম জেনারেল জিয়া একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছেন, জয় বাংলা বলে যুদ্ধেও গিয়েছেন, কিন্তু যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়া যা যা করেছেন, সেইসব ঘটনাগুলো কী মুক্তিযুদ্ধের মূল চার নীতির সাথে সম্পর্কিত ছিল ? ৩০ লাখ শহীদ কি জিয়ার মত মনোভাব রেখে দেশের জন্য রক্ত দিয়েছেন ?

আশা করি একজন আদর্শিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ব্যক্তির পক্ষে বিশ্বাস করা সম্ভব হবে না যে, জিয়াউর রহমান যা করেছে তা ছিল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চেতনার বাস্তবায়ন। আর তাই যদি না হয়, তাহলে যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও বীরত্বের জন্য জেনারেল জিয়াকে সরকার বীরউত্তম খেতাব দিয়েছিল, সে খেতাব যদি এখন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, তাহলে সেটা কেন খুব বেশি প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে যাবে?

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত