গৃহহীনকে গৃহদান : হোক দারিদ্র্যের অবসান

3083

Published on ফেব্রুয়ারি 2, 2021
  • Details Image

প্রণব কুমার পাণ্ডেঃ

অর্থনৈতিক ক্ষমতা নির্বিশেষে, আবাসন অধিকার বিশ্বব্যাপী প্রতিটি জাতির নাগরিকের অন্যতম অধিকার। আমাদের সংবিধানে খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থানকে বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক চাহিদা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে প্রতিটি নাগরিকের তার পরিবারের সদস্যদের সাথে বসবাসের জন্য একটি বাড়ি থাকা সাংবিধানিক অধিকার।

নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির একটি ভালো বাড়ি থাকা উচিত। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমাদের দেশে অনেক মানুষ রয়েছে, যাদের একটি বাড়ি নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দারিদ্র্যতা, জোরপূর্বক স্থানান্তর, অভিবাসনসহ বিভিন্ন কারণে মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ঘরছাড়া এই দরিদ্র মানুষগুলো মানসিক ব্যাধি এবং ট্রমায় ভোগে। সুতরাং একটি বাড়ি এই মানুষগুলোর থাকার ব্যবস্থাই করবে না, বরং তাদের মানসিক সমস্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন ট্রমা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে।

ঢাকাসহ অসংখ্য জনপদের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে নিজের বাড়ি না থাকার কারণে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় এবং বস্তিতে বসবাস করছে। এই দরিদ্র মানুষের মধ্যে ভাসমান এবং ভিক্ষুক সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে, যারা সাধারণত জীবিকার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকায় আসে। এ সমস্যাটি কেবল শহরগুলোতেই দেখা যায় না, গ্রামেও দেখা যায়। কারণ দেশের পল্লী অঞ্চলে হাজার হাজার দরিদ্র মানুষের স্থায়ী কোনো বাড়ি নেই। গৃহহীনতা মানুষকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তোলে এবং প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষকে আরও খারাপ অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়।

আমরা ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বর্ষব্যাপী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি। বর্তমান সরকার এ বছরকে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে। মুজিববর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে সরকার দেশের অভাবি ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের সহায়তার জন্য অসংখ্য প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যদিও কোভিড-১৯ মহামারিজনিত কারণে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান মূল সূচি থেকে বাদ পড়েছে।

মহামারি সৃষ্ট বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও সরকারের বেশ কয়েকটি মহৎ প্রকল্পের বাস্তবায়ন পুরোদমে চলমান। মুজিববর্ষে শেখ হাসিনা সরকারের অন্যতম প্রশংসনীয় উদ্যোগগুলোর মধ্যে একটি ছিল গৃহহীনদের বাড়ি প্রদানের সিদ্ধান্ত। এই লক্ষ্য অর্জনে, সরকার জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী পূর্তি উপলক্ষে ৮ লাখ ৮২ হাজার ০২৩ জন গৃহহীনকে আবাসন প্রদানের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে।

বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে একটি হলো ‘আশ্রয়ণ- ২’ যার অধীনে সরকার মুজিববর্ষে অনেক গৃহহীন মানুষকে বাড়ি প্রদান করবে। গত ২৩ জানুয়ারি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬৬ হাজার ১৮৯ পরিবারকে বাড়ির মালিকানা হস্তান্তর করেছেন এবং এবং ৩ হাজার ৭১৫ পরিবারকে একই প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন ব্যারাকে পুনর্বাসিত করেছেন। এটি মুজিববর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার। কর্মসূচির উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী আরও উল্লেখ করেছেন যে এর আগে সরকার ২ লাখ ৩০ হাজার পরিবারকে বাড়ি দিয়েছে। তারা ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য আরও এক লাখ বাড়ি নির্মাণের কাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে শুরু করবে।

আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প বাস্তবায়নের অন্যতম একটি ইতিবাচক দিক হলো সরকার এ প্রকল্পে হরিজন, হিজড়া, চা শ্রমিক এবং সমাজের প্রান্তিক অংশের পাশাপাশি দরিদ্র মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করেছে। গৃহহীনদের বাড়ি দেয়ার এরকম মহৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশংসার দাবিদার। সামাজিক, প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অভাবি গৃহহীন মানুষকে বাড়ি বিতরণ করার ওপর বিভিন্ন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। বাড়ির মালিকানা গ্রহণকালে দুর্বল মানুষের হাসি মুখ দেখে সবাই আনন্দিত হয়েছে। তাদের অনেকেই বাড়ির চাবি পাওয়ার সময় কাঁদছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন, এই কথা বলে যে বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং তার কন্যা আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিয়েছেন । এটি সরকারের একটি দুর্দান্ত অর্জন।

গৃহহীন মানুষকে আবাসন সরবরাহ করার সরকারের সিদ্ধান্তের একাধিক ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। প্রথমত, সরকার গৃহহীনতার অনুভূতি সংক্রান্ত ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে দরিদ্র এই মানুষগুলোকে শুধু সাহায্যই করেনি বরং তাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। দ্বিতীয়, এমন মহৎ উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের দরিদ্রবান্ধব নীতিই পরিস্ফুটিত হয়েছে । তৃতীয়ত, নেতা হিসেবে শেখ হাসিনার বিশ্বাসযোগ্যতা ও যোগ্যতা এই উদ্যোগের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি একটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন যে, তিনি তার বাবার মতো দরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ অনুভব করতে পারেন। বঙ্গবন্ধু জনবান্ধব নেতা ছিলেন, যিনি জনগণের উন্নতি ও দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বাবার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশ পরিচালনার মাধ্যমে শেখ হাসিনা একজন পরিণত রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন দেশের মধ্যে এবং দেশের গণ্ডির বাইরে। বাংলাদেশের কোনো পূর্ববর্তী সরকার গৃহহীন মানুষের দুর্ভোগ বিবেচনা করে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

নেতা আসেন এবং নেতা চলে যান- এটিই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বাভাবিক অনুশীলন। তবে সব নেতার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে দেশের নাগরিকরা স্মরণ করে না। দেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদানের জন্য দেশের সব নাগরিক তাকে স্মরণ করে এবং করবে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে উপস্থিত থাকবে। দেশের জনগণের কাছে তার ব্যতিক্রমী কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলছে। এমনকি তিনি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক নেতা হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছেন। রাজনৈতিক ভিন্নতা নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের উচিত প্রান্তিক জনগণকে গৃহহীনতা সংক্রান্ত মানসিক আঘাতজনিত সমস্যা থেকে বের করে নিয়ে আসার জন্য সরকারের এ উদ্যোগের প্রশংসা করা।

যেহেতু বাংলাদেশ বিভিন্ন খাতে দ্রুতগতিতে সাফল্য অর্জন করছে এমনকি কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যেও, সুতরাং এখন সময় এসেছে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করার। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে সরকার দেশের জনগণের মঙ্গলের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। মুজিববর্ষের সরকারি সব উদ্যোগের মধ্যে দুর্বল গৃহহীন মানুষকে বাড়ি প্রদানের ধারণাটি সবচেয়ে ব্যতিক্রমী। আসুন আমরা দরিদ্র মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি নাগরিকদের হাসি মুখের চেয়ে অন্য কিছু প্রত্যাশা করেন না। তাই, জনগণের হাসিমুখ ভবিষ্যতে আরও জনমুখী নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুপ্রাণিত করবে।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত