শেখ রাসেল ও তার হাসু আপা

9494

Published on অক্টোবর 17, 2020
  • Details Image
ড. রাশিদ আসকারীঃ
শেখ রাসেলের হাসু আপা দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ১৬০ মিলিয়ন মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের দায়িত্ব নিয়েছেন। আজ দিকে দিকে তার জয়ধ্বনি। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও তিনি তার বাবা-মা আর ভাইদের বিস্মৃত হননি। পঁচাত্তরের কালরাত্রির যে খুনিরা সদর্পে খুনের দায় স্বীকারের স্পর্ধা দেখিয়েছেন; কালো আইন করে বিচারের পথ রম্নদ্ধ করে রেখেছিলেন- রাসেলের হাসু আপা খুনিদের সেই দর্প চূর্ণ করে দিয়েছেন। খুনিদের রক্ষার কালো আইন বাতিল করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করেছেন। বিচারের রায় কার্যকর করেছেন। এতে নিশ্চয়ই রাসেলের আত্মা শান্তি পাবে। আর তার হাসু আপাও তার প্রিয় রাসেলকে খুঁজে পাবেন লক্ষ-কোটি রাসেলের মাঝে।
 
বঙ্গবন্ধুর পাঁচ সন্ত্মানের মধ্যে শেখ রাসেল (১৯৬৪-১৯৭৫) সবার ছোট ছিলেন। বেঁচে থাকলে আজ তার বয়স হতো ৫৬ বছর। জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে তার বেঁচে থাকবার কথাও ছিল। বড়বোন শেখ হাসিনা যেভাবে বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও রাজনীতির উত্তরাধিকারের পতাকা বয়ে নিয়ে চলেছেন নিপুণ দক্ষতায়, তার আরাধ্য সোনার বাংলা গড়ে তুলেছেন প্রগাঢ় আন্তরিকতায় বেঁচে থাকলে শেখ রাসেলও হয়ে উঠতে পারতেন সেই অগ্রযাত্রার আরেক সৈনিক। কিন্তু তিনি বাঁচতে পারেননি। তাকে বাঁচতে দেয়া হয়নি। জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহকে থমকে দেয়া হয়েছিল- ষড়যন্ত্রের নির্মম আঘাতে। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা যেমন ষড়যন্ত্রের নির্মম শিকার হয়েছিলেন পলাশীর প্রান্ত্মরে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তেমনি সপরিবারে ষড়যন্ত্রের নির্মম শিকার হয়েছিলেন ধানম-ির ৩২ নম্বরে।
 
পঁচাত্তরের সেই ভয়াল রাত্রির নিকষ কালো অন্ধকারে ষড়যন্ত্রের দমকা হাওয়ায় নিভে যাওয়া বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রোজ্জ্বল প্রদীপগুলোর সর্বশেষ প্রদীপটির নাম শেখ রাসেল। শেখ রাসেল কালবৈশাখীতে ঝরে পড়া একটি ছিন্ন মুকুল। একটি অপ্রস্ফুটিত কুঁড়ি, যা ফুটলে অনেক সুগন্ধ ছড়াতো। কিন্তু সেই কুঁড়িকে ফুটতে দেয়া হয়নি। এক ভয়ঙ্কর মালী তা ছিঁড়ে ফেলেছে। সেই বৃন্তচ্যুত গোলাপের কুঁড়ির শোক আজ আমাদের জাতীয় শোকে পরিণত হয়েছে। সত্যিই আগস্ট ট্রাজেডি মানব ইতিহাসের সব ট্রাজেডিকে হার মানাতে পারে শেখ রাসেলের শোক গাথার কারণে। তাই শেখ রাসেলের জন্মদিনের সব আনন্দ ম্স্নান হয়ে যায় তার মৃতু্যদিনের সব বেদনার পাশে।
 
শেখ রাসেল বঙ্গবন্ধুর পরম আদরের কনিষ্ঠ ছেলে। তার নামও বঙ্গবন্ধু রেখেছিলেন তার প্রিয় দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে। রাসেলের উদার, মানবতাবাদী ও বিজ্ঞান মনস্ক চেতনার ছায়া পড়ুক তার সন্ত্মানের ওপর- এটাই বঙ্গবন্ধু চাইতেন মনেপ্রাণে। বঙ্গবন্ধু নিজেও বার্ট্রান্ড রাসেলের একজন ভক্ত ছিলেন। ফুরসত পেলেই রাসেলের লেখা অনুবাদ করে শোনাতেন তার স্ত্রীকে। চাইতেন তার শেষ সন্তান যেন হয়ে ওঠে দার্শনিক রাসেলের মতো মুক্তমনা বিশাল হৃদয়ের মানুষ। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগের হাল ধরে ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ গড়ে তোলার জন্য যখন রাতদিন পরিশ্রম করে চলছিলেন তখন রাসেলের জন্ম হয়। ১৯৬৪ সালের নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে বঙ্গবন্ধুকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। তারপর ১৯৬৬-এর ঐতিহাসিক ছয়দফা, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গণমানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ মুজিবকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, মুজিবের কারাবরণ, প্রতিবাদে বাংলার আপামর জনগণের ফুঁসে ওঠা, ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন, ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইট, বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তার, নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ- প্রভৃতি ঐতিহাসিক ঘটনার ঘনঘটায় প্রতি মুহূর্তে পিতার পরশ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন শিশু রাসেল। যে পিতার সান্নিধ্য সন্তানের কাছে পুরো পৃথিবীর চাইতে মূল্যবান, সেই পিতা রাসেলের কাছে ছিলেন স্বপ্নপুরুষ। বঙ্গবন্ধু নিজেও শিশু রাসেলের এই মর্মবেদনা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, আর তাই মুক্তিযুদ্ধত্তোর স্বাধীন দেশে সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর সহস্র ব্যস্ততার মধ্যেও প্রায় সর্বক্ষণ পাশে পাশে রাখতেন পুত্র রাসেলকে। অফিসে, সভায়, সমিতিতে, ডাইনিং টেবিলে- এমনকি বিদেশ সফরে। সবখানে সর্বদাই রাসেলকে দেখা যেতো বাবাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে। জানি না তার শিশুমনে হয়তোবা সবসময় কাজ করতো বাবাকে হারানোর ভয়। তবে সে ভয় সত্যি হয়ে উঠেছিল রাসেলের জীবনে। সে এক মর্মান্তিক ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর আবাসিক পিএ এএফএম মোহিতুল ইসলামের ভাষ্যে ১৫ আগস্টের ঘটনাবলির এক মর্মন্তুদ বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে শিশু রাসেলের হত্যাকাণ্ডের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা পিশাচের চোখেও পানি আনে। খুনিরা রাসেল ও গৃহপরিচারিকা রম্নমাকে যখন নিচে নামায় তখন ভীতসন্ত্রস্ত রাসেল মোহিতুলকে আঁকড়ে ধরে জিজ্ঞেস করে "ওরা কি আমাকেও মারবে।" মোহিতুল অবুঝ শিশুকে আশ্বস্ত করে: 'না ওরা তোমার কোনো ক্ষতি করবে না।" মোহিতুল ভেবেছিল হয়তোবা এই নিষ্পাপ শিশুটিকে খুনিরা রেহাই দেবে। কিন্তু পাষান হৃদয় খুনিদের মনে শিশু রাসেলের জন্য কোনো করম্নণা সৃষ্টি হয়নি। কারণ এযে তাদের নীল নকশারই অংশ। রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে হত্যা করতে নিয়ে যাওয়া হয়। ছোট্ট রাসেল প্রাণ বাঁচানোর জন্য শেষ আকুতি করে: "আলস্নার দোহাই, আমাকে প্রাণে মেরো না। আমার হাসু আপু দুলাভাইয়ের সাথে জার্মানিতে থাকে। আমাকে তাদের কাছে পাঠাও।" রাসেলের এই কাতর আকুতি সহ্য করতে না পেরে একজন সেন্ট্রি তাকে বাড়ির দরজার পাশের সেন্ট্রিবক্সের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু প্রায় আধ ঘণ্টা পর একজন মেজর তাকে দেখতে পায় এবং ওপরতলায় নিয়ে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় রিভলভারের গুলিতে হত্যা করে। এর আগেই খুনিরা বাকি সবাইকে হত্যার কাজ সেরে রেখেছিল। বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়াও তার গ্রন্থে রাসেল হত্যাকাণ্ডের মর্মস্পর্শী বিবরণ দেন।
 
রাসেলের ছোট্ট পৃথিবী ছিল বাবা-মা, হাসু আপা, রেহানা আপু আর ভাইয়া শেখ কামাল আর শেখ জামালকে নিয়ে। ছোট্ট রাসেল ছিল সবার নয়নের মনি। এখনও রাসেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য কান্নাধারায়। কণ্ঠ বাকরুদ্ধ হয়ে আসে অব্যক্ত বেদনায়। জগত বরেণ্য নেত্রীকে সবকিছু ভুলে হয়ে উঠতে দেখি রাসেলের হাসু আপা। মনে হয় প্রধানমন্ত্রিত্বের চাইতে রাসেলের হাসু আপা হয়ে থাকা তার কাছে অনেক বেশি গৌরবের।
 
শেখ রাসেলের হাসু আপা দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ১৬০ মিলিয়ন মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের দায়িত্ব নিয়েছেন। আজ দিকে দিকে তার জয়ধ্বনি। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও তিনি তার বাবা-মা আর ভাইদের বিস্মৃত হননি। পঁচাত্তরের কালরাত্রির যে খুনিরা সদর্পে খুনের দায় স্বীকারের স্পর্ধা দেখিয়েছেন; কালো আইন করে বিচারের পথ রম্নদ্ধ করে রেখেছিলেন- রাসেলের হাসু আপা খুনিদের সেই দর্প চূর্ণ করে দিয়েছেন। খুনিদের রক্ষার কালো আইন বাতিল করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করেছেন। বিচারের রায় কার্যকর করেছেন। এতে নিশ্চয়ই রাসেলের আত্মা শান্ত্মি পাবে। আর তার হাসু আপাও তার প্রিয় রাসেলকে খুঁজে পাবেন লক্ষ-কোটি রাসেলের মাঝে।
 
লেখকঃ কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। সাবেক উপাচার্য, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত