'নিউ নরমাল' জীবনের সঙ্গে বসতি

3349

Published on জুলাই 3, 2020
  • Details Image

প্রণব কুমার পাণ্ডেঃ

'নিউ নরমাল' শব্দটির অভিধানিক অর্থ 'পূর্ববর্তী অপরিচিত বা নাটকীয় পরিস্থিতি যা আদর্শ, স্বাভাবিক বা প্রত্যাশিত হয়ে উঠেছে।' ফলে যে বিষয়টি আমাদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না, সেই নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার বিষয়টি অবশ্যই কঠিন একটি কাজ। তবে আমরা যদি কভিড-১৯ নামক মহামারি থেকে রক্ষা পেতে এবং নিরাপদ থাকতে চাই, যতই অপ্রত্যাশিত বা আকস্মিক হোক না কেন এই 'নিউ নরমাল' পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের খাপ খাইয়ে চলতেই হবে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কভিড-১৯-এর মাধ্যমে আমাদের জীবনযাত্রায় অবিশ্বাস্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আমরা কয়েক মাস আগেও টয়লেট টিস্যুর গুরুত্ব সম্পর্কে তেমন ভাবতাম না। তবে, বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এটি সোনার মতো মূল্যবান হয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা অনেকেই সাধারণ মুদি দোকানে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। খুব বেশি হলে সপ্তাহে এক দিন যাওয়া হয়। ফলে জীবনের প্রয়োজনে এবং বেঁচে থাকার তাগিদে আমাদের পুরোনো জীবনযাত্রাকে ছেড়ে দিয়ে এই 'নিউ নরমাল' পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে। তবে এটি ঠিক যে, এই 'নিউ নরমাল' পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, নিউ নরমাল জীবনের সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ্য করেছি, সরকার সর্বস্তরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। তবে একটি উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন হলো- গণপরিবহন ব্যবহারকারীদের বা শিল্প ও কারখানায় কর্মরত মানুষের পক্ষে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা কিংবা নিরাপদ স্যানিটেশন চর্চা করা আদৌ সম্ভব কি? আমরা সকলেই অবগত যে, দেশজুড়ে বিপুলসংখ্যক মানুষ গণপরিবহন ব্যবহার করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলাচল করে। রাস্তায় গণপরিবহন চালানোর সময় পরিবহন মালিকদের জন্য সরকার কিছু নির্দেশনা প্রদান করেছে। এগুলোর মধ্যে হলো প্রতিবার ট্রিপ পরিচালনার পূর্বে বাসে জীবাণুনাশক স্প্রে প্রয়োগের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত করা এবং বাসে প্রবেশের পূর্বে সব যাত্রীর হাতে স্যানিটাইজার দেওয়া। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, কিছু আন্তঃনগর বাস বাদে এই বিধিগুলো অনুসরণ করা হচ্ছে না। বরং যাত্রীদের শরীরে ব্লিচিং পাউডারের স্প্রে করা হচ্ছে, যা তাদের দীর্ঘ মেয়াদে চর্ম রোগের ঝুঁকিতে ফেলছে। এমনকি অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বাস চলার কথা থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গণপরিবহনগুলো পূর্ণ যাত্রী বহন করছে। ফলে বাস ভাড়া ৬০% ভাড়া বৃদ্ধি করা হলেও জনগণ স্বাস্থ্যবিধি মানার সুযোগ থেকে শুধু বঞ্চিতই হচ্ছে না; বরং কভিড-১৯-এর সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকছে। ফলে নিউ নরমাল জীবনে মানুষকে অভ্যস্ত করার জন্য সরকারি তদারকি ব্যবস্থা শক্তিশালী করার প্রয়োজন।

অন্যদিকে, যারা সরকারি চাকরিজীবী কিংবা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সেক্টরে চাকরি করেন তারা কি এই নিউ নরমাল জীবনের সথেঙ্গ সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলতে পারছেন? ইতোমধ্যে আমরা লক্ষ্য করেছি, প্রায় সব ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীরা মুখে মাস্ক পরিধান করছেন। তবে, অফিসে আসা-যাওয়ার সময় গণপরিবহন ব্যবহারের ফলে তারা বেশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। অন্যদিকে, তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিসে লিফট ব্যবহার করছেন না। সাম্প্রতিক সময়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, লিফটের মাধ্যমে কভিড-১৯ সংক্রমণ ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে ছড়াতে পারে। আবার যে সব কর্মচারী কলকারখানায় চাকরি করেন তাদের পক্ষে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা এবং নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবহার করা কঠিন। কারণ একটি ছোট স্থানে অনেক মানুষ কাজ করে। ফলে কভিড-১৯-পরবর্তী নিউ নরমাল জীবনের সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য সরকারি সংস্থাগুলোতে দৃঢ় নজরদারি বজায় রাখতে হবে এবং প্রয়োজনবোধে বল প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষকে মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে।

নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে অভিভাবক ও সরকার খুবই শঙ্কিত। শিক্ষার্থীরা বর্তমান সময়ে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী, কারণ প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত সব স্তরের শিক্ষার্থীকে নিউ নরমাল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো খুব সহজ বিষয় নয়। কারণ শিক্ষার্থীদের ঘন ঘন হাতে স্যানিটাইজার দেওয়া বা হাত ধোয়া নিশ্চিত করা কিংবা ক্লাস ও ক্লাসের বাইরে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা খুবই কঠিন। এর দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত. আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সেই সক্ষমতা নেই, যাতে করে তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে পারবে। অন্যদিকে, ছোট ছোট শ্রেণিকক্ষে অনেক সংখ্যক শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা হয়। ফলে সেখানে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশের বেশিরভাগ অভিভাবকের স্বাস্থ্যবিধির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সন্তানদের সরবরাহ করার মতো সক্ষমতা নেই। ফলে, সার্বিক বিষয় মাথায় রেখে সময় নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিউ নরমাল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য প্রস্তুত করতে হবে। নিউ নরমাল জীবনযাত্রার সঙ্গে তারা কীভাবে নিজেদের খাপ খাওয়াবে, তা শেখানোর জন্য ব্যাপকভিত্তিক সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক প্রকল্প হাতে নেওয়া প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। আর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন না করা পর্যন্ত সরকার অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে পারে, যাতে এই কোমলমতী শিক্ষার্থীরা ঘরে অলস বসে সময় নষ্ট না করে।

ফলে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে সকল নাগরিককে কভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে নিউ নরমাল জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বিগত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় যে, জনগণের একটি বিশাল অংশ কভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন নির্দেশনা মেনে চলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণ উৎসাহী ছিল না। সুতরাং, এই জনগোষ্ঠীকে নিউ নরমাল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হলে কিছু কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ করা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাড়ির বাইরে বের হলে নাগরিকদের জন্য মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছে। কেউ এই নিয়ম লঙ্ঘন করলে তাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে। ফলে আমাদের দেশেও সরকারের উচিত জনগণকে নিউ নরমাল জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য ক্ষেত্রবিশেষে বল প্রয়োগ করা। যদি এটি না করা হয় তাহলে সরকারি ছুটি চলাকালে যে ঘটনা ঘটেছে সেটির আবার পুনরাবৃত্তি হবে। তবে, বল প্রয়োগের বিষয়টি অনেকেই সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখতে পারে। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, কোনো নীতির সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য অনেক সময় সরকারকে বল প্রয়োগ করতে হয় কোনো কোনো অ্যাক্টরের বিরুদ্ধে, যারা নীতি বাস্তবায়নে অসহযোগিতা করে। সুতরাং, কভিড-১৯-পরবর্তী নিউ নরমাল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও সকলের সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অসম্ভব নয়।

লেখকঃ অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত