৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ঃ বিজয় সমাগত!

3340

Published on ডিসেম্বর 4, 2019
  • Details Image

১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর দিনটি ছিল শনিবার। এই দিন বাংলাদেশের সকল রণক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকায় হানাদার বাহিনী সর্বত্র পিছু হটছিল। পাকিস্তানী বিমান বাহিনী ক্রমশ পঙ্গু হয়ে পড়ছিল। সীমান্ত শহর দর্শনা সম্মিলিত বাহিনীর দখলে চলে আসে।

এদিকে ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী বাংলাদেশে দখলদার বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। চতুর্দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এগিয়ে আসে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, করাচী-শত্রু ঘাঁটিতে চলে বোমাবর্ষণ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের আকাশে চলে জোর বিমান যুদ্ধ। সর্বাত্মক যুদ্ধের এই দিনে পশ্চিম সেক্টর থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর সব ক’টি কলাম পূর্বে এগিয়ে যায়। কোথাও তারা সোজাসুজি পাকঘাঁটিগুলোর দিকে এগোয় না। মূল বাহিনী সর্বদাই ঘাঁটিগুলোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। সেই সঙ্গে পাক বাহিনীকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রত্যেক ঘাঁটিতে অবিরাম গোলাবর্ষণ চালাতে থাকে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলো বার বার ঢাকা, চট্টগ্রাম, চালনা প্রভৃতি এলাকার সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। ঢাকার বিমান যুদ্ধ মারাত্মক আকার ধারণ করে। প্রথম রাতের আক্রমণেই পাকিস্তানের বিমান বহরের প্রায় অর্ধেক বিমান ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর মিলিত প্রত্যাঘাত, ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণ ও নৌবাহিনীর অবরোধের মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধের চিত্র এভাবে আমূল পরিবতির্ত হয়। ভারত গেরিলা বেষ্টিত ঢাকায় ফাইটার দিয়ে সব দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। প্রায় ৮০০০ গেরিলা সারা শহরে সক্রিয় ছিল। গুল টেক্সটাইল মিলসে মুক্তিফৌজের গেরিলারা শত্রুদের বাংকারে হামলা চালিয়ে ২৭ সৈন্যকে হত্যা করলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সেই এলাকা থেকে পিছু হটে। ১১ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর এইদিন বিকাল ৩টার সময় হানাদার বাহিনীর কামালপুর ঘাঁটির সেনারা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। নিয়মিত বাহিনীর ২২০ জন সদস্য বিপুল অস্ত্রশস্ত্রসহ বন্দী হয়। এই অবরোধ চলাকালে তারা ৭ দিন বাইরে আসার চেষ্টা করলে বিপুল বাধার সম্মুখীন হয়ে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তিনদিন ধরে কামালপুর থেকে মুক্তি বাহিনীর অবরোধ ভেঙ্গে পাক বাহিনী বের হয়ে যাবার চেষ্টা করলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

কামালপুরের পতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাক বাহিনী ময়মনসিংহের মেঘালয় সীমান্তের সব এলাকাতে মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং দ্রুত পশ্চাদপসারণ করে। জামালপুর, ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় মুক্তিবাহিনী অভিযান করার জন্য সমবেত হয়। ভালুকা থানার চাপড়াবাড়ী এলাকায় রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ৩ জন রাজাকার হত্যা করা হয়। একই দিন কোম্পানি কমান্ডার মোছলেহ উদ্দিন আহমেদ ও প্লাটুন কমান্ডার গিয়াসউদ্দিন আহমেদ একদল মুক্তিসেনা নিয়ে কাঁঠালী ও বাশিল এলাকায় পাক বাহিনীর ওপর আক্রমণ করলে ৭ জন পাকসেনা ও ১০ জন রাজাকার নিহত ও কয়েকজন আহত হয় । ৪ নম্বর সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল সিআর দত্ত এবং জেড ফোর্সের মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সিলেটের কানাইঘাট দখলের পর এলাকায় শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেন। ৩নং সেক্টরের মুক্তি বাহিনী শমসের নগর বিমান বন্দর এবং আখাউড়া রেল স্টেশন দখল করে। ৮নং সেক্টরের মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর দখল করে যশোরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবমেরিন পিএনএস গাজী বিশাখাপত্তম বন্দরের কাছে আক্রান্ত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের জন্য দিনটি ছিল অস্থির আর উদ্বেগের। পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সিনিয়র জর্জ বুশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে দাবি করে যে, ‘এ মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তান নিজ নিজ সীমান্তের ভেতর সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে।’ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস করানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র তখন বৈঠকের পর বৈঠক করছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো প্রয়োগের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে ভেস্তে যায়। পোল্যান্ডও এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। তবে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকে। প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র যখন হেরে গিয়েছিল তখন পাকিস্তানের পরাজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এক বিবৃতিতে ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করলেন : ‘ঞড়ফধু, ঃযব ধিৎ রহ ইধহমষধফবংয যধং নবপড়সব ধ ধিৎ ড়হ ওহফরধৃ. ডব যধাব হড় ড়ঃযবৎ ড়ঢ়ঃরড়হ নঁঃ ঃড় ঢ়ঁঃ ড়ঁৎ পড়ঁহঃৎু ড়হ ধ ধিৎ ভড়ড়ঃরহম’. প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুরে জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করে বলেন, আমরা অনেক সহ্য করেছি। এখন শত্রুর প্রতি চরম ধ্বংসাত্মক প্রত্যাঘাত হানার সময় এসেছে। আমাদের সেনাবাহিনী শত্রুকে কেবল আমাদের ভূখ- থেকেই বিতাড়িত করবে না, শত্রুর ভূখ-ে গিয়ে তাদের নির্মূল করবে। রাওয়ালপিন্ডিতে একজন সরকারী মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তানের উভয় অংশে যুদ্ধ চলছে। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় চাপ মোকাবেলা করা হচ্ছে। চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফেই এ দিনে পাকিস্তানের ওপর ভারতীয় হামলার নিন্দা করে ইসলামাবাদকে দৃঢ় সমর্থন দেয়ার অঙ্গীকার করেন। বাংলাদেশ প্রশ্নে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গণচীনের প্রতিনিধি মি. হুয়াং হু এক বিবৃতিতে বলেন, ইদানীং ভারতীয় সরকার কোন গোপনীয়তা ছাড়াই পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করার জন্য সেনা পাঠাচ্ছে এবং বিশাল পরিসরে সশস্ত্র যুদ্ধ ঘটাচ্ছে। এভাবেই ভারত পাকিস্তান উপমহাদেশ ও এশিয়ার মাঝে সম্পর্ক ক্রমশ বিরক্তিকর হয়ে উঠল। এ ব্যাপারে চায়না সরকার ও জনসাধারণ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করল এবং পরিস্থিতির উন্নয়নের আশা ব্যক্ত করল।

১) পশ্চিম পাকিস্তানের আগ্রহ পুরোপুরিভাবেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নিবদ্ধ ছিল, যেখানে কিনা নাক গলানোর অধিকার কারোরই নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের আগ্রহের অজুহাতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলা চালানো ভারতীয় সরকারের জন্য অবৈধ।

২) ভারতীয় সরকার দাবি করল তারা পশ্চিম পাকিস্তানে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছে। এটি নিছক বেপরোয়া যুক্তি। ‘ঞযব ভধপঃং ংযড়ি ঃযধঃ রঃ রং ধ ওহফরধ যিরপয যধং পড়সসরঃঃবফ ধমমৎবংংরড়হ ধমধরহংঃ চধশরংঃধহ ধহফ হড়ঃ চধশরংঃধহ যিরপয যধং ‘সবহধহপবফ’ ঃযব ংবপঁৎরঃু ড়ভ ওহফরধ’. ভারতীয় সরকারের যুক্তি অনুসারে, অন্য কোন দেশকে আক্রমণ করার জন্য যে কেউ ‘আত্মরক্ষা’র অজুহাত ব্যবহার করতে পারে। এ ক্ষেত্রে, বিভিন্ন দেশের সার্বভৌম ক্ষমতা ও রাষ্ট্রাধীন অখ-তার নিশ্চয়তা কি?

৩) ভারতীয় সরকার দাবি করল, সেনাবাহিনী পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো পশ্চিম পাকিস্তানকে আক্রমণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীদের সাহায্য করে তাদের নিজ দেশে পাঠানো। এটি নিতান্তই অসমর্থনীয়। বর্তমানে তিব্বত, চায়না থেকে বিশাল সংখ্যায় তথাকথিত ‘আশ্রয় প্রার্থী’ ভারতে আছে, ভারতীয় সরকার দালাইলামাকে পরিচর্যা করছেন যিনি কিনা তিব্বতীয় পাল্টা বিপ্লব বিদ্রোহের প্রধান। ভারতীয় সরকারের দাবি অনুসারে, তারা কি এর ওপর ভিত্তি করে চায়নার বিরুদ্ধেও হামলা চালাবে?

৪) পাকিস্তানী সরকার পর্যায়ক্রমে দু’পাশের সীমান্ত থেকে সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহার ও বিচ্ছিন্ন করার এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীদের স্থায়ী হওয়া প্রসঙ্গে দুই সরকারের মাঝে আলোচনার প্রস্তাব দিল। এটি সম্পূর্ণরূপে যুক্তিসঙ্গত। যাই হোক, ভারতীয় সরকার অকস্মাত তা নাকচ করে দিল। এ থেকে দেখা যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শরণার্থীদের সমস্যার স্থায়ী সমাধানে ভারতীয় সরকারের কোন উদ্দেশ্যই নেই উপরন্তু এই সমস্যাকে পুঁঁজি করে অজুহাত হিসেবে নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ধ্বংস ও আক্রমণ করতে চায়। জাতিসংঘের দলিল অনুসারে চাইনিজ প্রতিনিধি দল মনে করে, নিরাপত্তা পরিষদের উচিত ভারতীয় সরকারের আক্রমণাত্মক আচরণের তীব্র নিন্দা করা এবং ভারতীয় সরকার যেন অবিলম্বে ও নিঃশর্তভাবে পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহার করে সেই দাবি করা। পরিশেষে, চায়না সরকারের পক্ষ থেকে আমি বলতে চাই যে, চায়না সরকার ও জনসাধারণ কঠোরভাবে পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন করে এবং তাদের জনসাধারণ শুধু ভারতের হামলার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করে। এখানে আমি নিরাপত্তা পরিষদ, জাতিসংঘ ও পৃথিবীর জনসাধারণকে ইঙ্গিত করে বলতে চাই যে, ভারতীয় সরকারের সাম্প্রতিক আক্রমণাত্মক কার্যক্রম সংগঠিত হয়েছে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনে। সত্য ঘটনার প্রাচুর্যে এটি সমর্থিত। এই দিন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক চিঠিতে বলেনÑ মাননীয়া, ৩ ডিসেম্বর আপনাদের দেশে পাকিস্তান সামরিক জান্তার অতর্কিত আক্রমণের কথা শুনে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। ... ইয়াহিয়া ও তার জেনারেলদের মাধ্যমে আপনার দেশে যে ধ্বংস সংঘটিত হয়েছ এখন আমাদের উচিত এই আগ্রাসন দমন করতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এর প্রতিবাদ করা ও স্বাধীনতা লাভের জন্য একজোট হওয়া। তাই আমি অনুরোধ করতে চাই, আমরা যদি কূটনৈতিকভাবে একজোট হই তাহলে সহজেই আমাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা লাভ করতে পারব। আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, বাংলাদেশের মানুষ ও বাংলাদেশ সরকার এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে যে কোন বিপদেই দুই দেশের পাশে সমানভাবে দাঁড়াবে। আমরা আশাবাদী যে আমাদের এই একতা ইয়াহিয়া বাহিনীর ঘৃণ্য চক্রান্তকে প্রতিহত করবে ও আমাদেরকে একটি আশাব্যঞ্জক ফলাফল দেবে। আমরা যে কোন বিপদেই আপনাদের পাশে দাঁড়াব ও পূর্ণ সহযোগিতা করব। ঢাকায় বিবিসির বিশেষ প্রতিনিধি বলেছেন শহরে ক্রমাগত বিমান স্থাপনায় ভারতীয় বিমান রকেট ও কামানের শেলিং করছে। তিনি দুটি বিমানকে গ্রাউন্ড টায়ারের আক্রমণে ভূপাতিত হতে দেখেন। নিউইয়র্ক টাইমস এর সংবাদ ভাষ্য থেকে জানা যায়, এই সঙ্কটে সাড়া দিয়ে সংঘাতের মূল কারণটি চিহ্নিত করা খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের অসহনীয় নিপীড়ন প্রতিবেশী ভারতের অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছিল। লন্ডনের দ্য ডেইলি মিররের সংবাদ থেকে জানা যায়, পাকিস্তান-ভারত নয় পুরো পশ্চিম এশিয়াকে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত