পাকিস্তানি ভাবাদর্শে ফেরাই ছিল লক্ষ্য

6290

Published on আগস্ট 16, 2018
  • Details Image

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা সরকারগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের নতুন মাত্রা পাওয়ার তথ্য রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত হাওয়ার্ড বি শ্যাফারের (১৯২৯-২০১৭) জবানিতে। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৭ সালে ঢাকায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করা হাওয়ার্ড বি শ্যাফার ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় পাকিস্তানে মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক কাউন্সেলর ছিলেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতেও মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক কাউন্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তানে যখন ছিলাম, তখন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বয়স মাত্র কয়েক বছর। ১৯৭৫ সালের গ্রীষ্মের (ওয়াশিংটনে জুন থেকে আগস্ট) আগে দুই দেশের (বাংলাদেশ ও পাকিস্তান) মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না।’

মার্কিন কংগ্রেসের লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ওই সাক্ষাৎকারে হাওয়ার্ড বি শ্যাফার আরো বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান—১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যাকে মূল্যায়ন করা হয়, তাঁকে হত্যা ও তাঁর সরকারকে যখন উৎখাত করা হয় তখন আমি ইসলামাবাদে আছি প্রায় এক বছর। এরপর (বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশে) যে সরকারগুলো এসেছিল তাদের মধ্যে পাকিস্তান ও ইসলামী সংযোগের প্রতি আরো অনেক উদার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।’

শ্যাফার বলেন, ইসলামাবাদে তাঁর কর্মজীবনের (১৯৭৪-১৯৭৭) দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু-পরবর্তী সরকারগুলোর সম্পর্কের অনেক উষ্ণতা দেখতে পান। বিহারি হিসেবে পরিচিত আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত পাঠানোসহ পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত যেসব ইস্যু সমাধানে বঙ্গবন্ধুর সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছিল সেগুলো তখন গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। আটকে পড়া পাকিস্তানিদের পাকিস্তানে ফেরার আগ্রহের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সরকারের কাছে সময় সময় তুললেও এ বিষয়ে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারগুলোর খুব একটা আগ্রহ ছিল না।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিমের জবানিতেও কথিত ভারত-সোভিয়েত প্রভাবমুক্ত দেশ গড়তে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎখাতের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ আছে। তবে কথিত সেই প্রভাবমুক্ত হতে গিয়ে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের প্রভাব পড়ার তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় আমেরিকান সাংবাদিক মার্কাস ফ্রান্ডার প্রতিবেদনে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক্সিকিউটিভ ইন্টেলিজেন্স রিভিউয়ের (ইআইআর) ১৯৯২ সালের ১৬ অক্টোবরের সংস্করণে দক্ষিণ এশীয় বিশ্লেষক রামতনু মৈত্র লিখেছেন, বঙ্গ্বন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ১৫ জনকে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন ঢাকায় আরো দুটি ভাষ্য প্রচার পেয়েছিল। এর একটি হলো সেনাপ্রধান পদ প্রত্যাশী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক আইন জারির পক্ষে ছিলেন এবং এ ক্ষেত্রে তাঁর সমর্থক ছিলেন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ডেভিড বোস্টার। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগেভাগেই মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন।

দ্বিতীয় ভাষ্যটি আমেরিকান সাংবাদিক মার্কাস ফ্রান্ডার (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের প্রফেসর ইমেরিটাস) প্রতিবেদনেই উল্লেখ ছিল। মার্কাস ফ্রান্ডা তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের আগেই ভারত সরকার বঙ্গবন্ধুকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছিল। এমনকি কয়েকজন আমেরিকানও আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তাজউদ্দীন আহমদকে জানালে তিনিও বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন।

ইআইআরের ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য যাই থাকুক না কেন ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্পষ্টতই বেশ কিছু কৌশলগত দিক নির্দেশ করে। ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। পুরো ভারত তখন স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনে ব্যস্ত।

রামতনু মৈত্র লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ও উৎখাতের জন্য খুব সম্ভবত ১৫ আগস্টকে বেছে নেওয়া হয়েছিল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে একটি বার্তা দেওয়ার জন্য। বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ইন্দিরার সেরা বন্ধু।

খুনি শরিফুল হক ডালিমের জবানিতেও বঙ্গবন্ধুকে উৎখাতের জন্য ১৫ আগস্ট তারিখটি বেছে নেওয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠান উপলক্ষে জাতীয় পর্যায়ের সব নেতা সে সময় ঢাকায় ছিলেন। জাতীয় রক্ষীবাহিনীর ডিরেক্টর ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান ও ডেপুটি ডিরেক্টর কর্নেল সাব্বিউদ্দিন দুজনেই যে ওই সময় দেশের বাইরে থাকবেন তা আগেই জানা ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের। একই সঙ্গে ভারত ব্যস্ত থাকবে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনে। এ ছাড়া ১৯৭৫ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট রাতে ঢাকা ব্রিগেডের প্রশিক্ষণ নির্ধারিত ছিল। এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে ১২ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারীরা ঠিক করেছিল ১৫ আগস্ট ভোরে হামলা চালাবে।

মার্কাস ফ্রান্ডা তাঁর এক নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য খুনিচক্রের ১৫ আগস্টকে বেছে নেওয়ার পাশাপাশি আরো বেশ কিছু ঘটনা তুলে ধরেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার ১৬ দিন পর ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ‘ভারতের হুমকি’ মোকাবেলায় চীনের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোরবিরোধী সৌদি আরব বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরপরই বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তান রেডিও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর জানানোর পাশাপাশি গৌরবের সঙ্গে প্রচার করেছিল, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নাম বদলে ‘ইসলামিক প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ হয়েছে।’

মার্কাস ফ্রান্ডার নিবন্ধে লেখা হয়েছে, ভারতের চ্যালেঞ্জের মুখে তখন ঢাকার নিয়ন্ত্রকরা বাংলাদেশের নাম বদলানোর বিষয়টি অস্বীকার করেন। ঢাকায় অভ্যুত্থানের খবর শুনে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় আধা সামরিক বাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় খন্দকার মোশতাক আহমদ পশ্চিমা ও ইসলামীপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাকই রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে আরেকটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষমতায় আসেন বামপন্থী সেনা কর্মকর্তা কর্নেল আবু তাহের। এরপর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্যদের হত্যা করা হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।

রামতনু মৈত্র লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র-চীন-সৌদি বলয়ের প্রভাব শক্তিশালী হয়। তারাই নতুন সরকারের আমলে বাংলাদেশের জন্য অর্থ, সামরিক সহযোগিতা দেওয়া শুরু করে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা সবাই ছিল পাকিস্তানের পক্ষে।

সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত