অনলাইন ক্লাস ও কিছু কথা

4730

Published on জুলাই 4, 2020
  • Details Image

ড. জেবউননেছাঃ

আমার ছেলে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে নবম শ্রেণীর মানবিক শাখার ক্লাস প্রতিনিধিত্ব করে। কদিন আগে অনলাইনে কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় জানালেন, শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস হবে। সে কারণে শিক্ষার্থীরা যেন শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করে। সে তার শ্রেণী শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ করল। এরপর শ্রেণী শিক্ষকের নেতৃত্বে হয়ে গেল একটি মেসেঞ্জার গ্রুপ। এখন তারা জুম ক্লাউডের মাধ্যমে ক্লাসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে শ্রেণী অনুযায়ী ধারণকৃত ক্লাস প্রতিদিনই লকডাউনের পর থেকে শিক্ষকেরা আপলোড করে যাচ্ছেন কলেজের অনলাইন গ্রুপে। এটি সম্ভব হয়েছে কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয়ের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতায় এবং কলেজের শিক্ষকদের সহযোগিতায়।

এ বিষয়টি স্বচক্ষে অবলোকন করার পর আশায় দিন গুনতে থাকি কবে আমার শিক্ষাথীদের সাথে এই পদ্ধতিতে আমি এগুবো। যদিও আমি নিয়মিতই শিক্ষার্থীদের সাথে অনলাইনে যোগাযোগ রেখেছি এবং পাঠের বেশ কিছু কাজ শিক্ষার্থীদের দিয়েছি নিজ উদ্যোগে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে আমি পার্টটাইম পাঠদানের অংশ হিসেবে লকডাউনেই অনলাইনে পাঠদান করেছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শ্রেণীপাঠ শুরুর পূর্বে নিয়মানুযায়ী কোর্সের সমস্ত লেকচার প্রেজেন্টেশন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে আপলোড করে দিতে হয়। প্রতিটি শিক্ষার্থীর একটি আইডি ও পাসওয়ার্ড রয়েছে। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থী তার পরীক্ষার নাম্বার এবং উপস্থিতি দেখতে পারে। অনলাইনে লাইব্রেরির সীমিতভাবে ব্যবহার করার সুযোগ শিক্ষার্থীদের রয়েছে।

গতকাল (২৮ মে) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারিকৃত ১০ নং নির্দেশনায় ‘অনলাইন কোর্স, ডিসট্যান্স লার্নিং অব্যাহত থাকবে’ মর্মে নির্দেশনা পাবার পর সামাজিক মাধ্যমে লিখলাম, ‘লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীদের সেশনজট থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক অনলাইন ক্লাসের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি। আমি আনন্দিত’। সামাজিক মাধ্যমে মতামতটি দেয়ার পর লক্ষ্য করলাম, কেউ সমর্থন করছেন। কেউ করছেন না। কেউ বলছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে গবেষণা করা উচিত ছিল। কেউ বলছেন, অনেকের ডাটা ক্রয়ের টাকা নেই। কেউ বলছেন আমরা এখনো প্রস্তুত নই। আবার কেউ কেউ স্বাগত জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে অবহিত হয়েছিলাম, বাংলাদেশের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ও কিছু বিভাগে অনলাইনে ক্লাস হয়েছে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ভারতের বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ড. রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য স্যার, যিনি আমার পিএইচডি গবেষণার সম্মানিত তত্ত্বাবধায়ক, তার কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলাম, স্যার আপনার বিশ্ববিদ্যালয় লকডাউনে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিক্ষার্থীদের জন্য? স্যার জানালেন, ভারতে ২৪ মার্চ লকডাউন ঘোষণার পরপরই পশ্চিমবঙ্গের উচ্চশিক্ষা দফতর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পত্র প্রেরণ করে, অনলাইন ক্লাসের সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে। উপাচার্য সেই পত্র গ্রহণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের প্রধান রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিভিন্ন অনুষদের ডিনদের নিয়ে অনলাইনে সভা ডাকেন। সেই সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, লকডাউনে ১ এপ্রিল থেকে অনলাইন ক্লাসে পাঠদান করা হবে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রতিদিন তিন ঘণ্টা করে পাঠদান করা হয়। একজন শিক্ষক সপ্তাহে ৮টি ক্লাস নেন। ক্লাসের ব্যাপ্তি ৪০ মিনিট। প্রতি ক্লাসে ১০ মিনিট করে বিরতি দেয়া হয়। প্রশাসনের পরামর্শে প্রতি ক্লাস শুরুর প্রথম পাঁচ মিনিটে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে কোনো সমস্যায় আছে কি-না, জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং বিষন্নতায় ভুগছে কি-না, এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চান প্রত্যেক শিক্ষক। তবে ক্লাসে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। বাকি ২০ শতাংশ যারা বিভিন্ন সমস্যার কারণে ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারছে না, তাদের জন্য লকডাউনের পরপরই টানা একমাস পাঠদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রতি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের হোয়্যাটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে। সেখানে শিক্ষকরা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করেন। পাঠের সাথে সম্পৃক্ত স্টাডি ম্যাটেরিয়ালস হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে দেয়া হয়। শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে ডাউনলোড করে নেয়। তবে তিন ঘণ্টা করে ক্লাস নেবার একটি কারণও আছে। সেটি হলো রাজ্যের মুঠোফোন পরিসেবায় একটি প্যাকেজ আছে। সেটি হলো ৩৯৯ টাকায় ৮৪ দিন কথা বলা যাবে। প্রতি দিন ১.৫জিবি করে বোনাস পাবে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের মুঠোফোনের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়া, মুঠোফোন গরম হয়ে যাওয়া এ বিষয়গুলোও বিবেচনা করা হয়েছে। স্যাররা যখন অনলাইনে পাঠদান শুরু করেন, তখন শিক্ষা পাঠক্রম অর্ধেক ছিল। এখন তাদের সিলেবাস শেষ। কিছু কিছু কোর্সে পুনরালোচনা চলছে। শুধু তাই নয়, ইতোমধ্যে উপাচার্য অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের প্রধান রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিভিন্ন অনুষদের ডিনদের নিয়ে তিনটি সভা করেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভাগীয় কমিটির সভা হয়েছে। তিনটি জয়েন্ট ফ্যাকাল্টি মিটিং হয়েছে একটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের সিলেবাস পরিমার্জন কমিটির সভা হয়েছে দুটি। প্রতিদিন শিক্ষার্থীরা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত অনলাইন পাঠে যুক্ত থাকে। এ ধরনের পাঠে কোনো ধরনের সমস্যা হচ্ছে না বলে স্যার জানান।

সর্বশেষ ৮ মে উপাচার্য অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের প্রধান রেজিস্ট্রার,পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিভিন্ন অনুষদের ডিনদের নিয়ে সভা করেছেন। সেদিন ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী। অনলাইনে ১১টা থেকে শুরু হয়ে সেই সভা শেষ হয়েছে ১টা ২০ মিনিটে। সভার শেষ দিকে বিশ্বকবির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়; রবীন্দ্রনাথের গান এবং কবিতা দিয়ে। উপাচার্য বিশ্বকবিকে স্মরণ করে সভায় বক্তব্য দেন। ইউজিসির বিভিন্ন ডিজিটাল লাইব্রেরির লিংক শিক্ষার্থীদের দেয়া হয়েছে। যেখান থেকে শিক্ষার্থীরা কোর্স সংক্রান্ত সহায়তা পেয়ে থাকে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে লকডাউনে শিক্ষা কার্যক্রমের কথা শুনে একটি অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছিল।

স্যারের সাথে কথা শেষ করে অস্ট্রেলিয়ার মারডক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণার আমার সহপাঠীর কাছে করোনায় শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলাম। সে জানালো, তার বিশ্ববিদ্যালয়ে লকডাউনে শিক্ষা কার্যক্রম একদিনও ব্যাহত হয়নি। নিয়মিত অনলাইনে ক্লাস-পরীক্ষা হচ্ছে। প্রতিটি শিক্ষক কনটেন্ট ডেভেলপ করে শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগে থাকেন। যে শিক্ষাথীদের ল্যাপটপ নেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল্যাপটপ ধার দেয়া হয়েছে। সাথে দেয়া হয়েছে ১০০ ডলার। এছাড়া সার্বক্ষণিক লাইব্রেরির বই-পুস্তক অনলাইনে পড়ার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া বিদেশি শিক্ষার্থীদের ৫০ ডলার করে খাদ্য কুপন দেয়া হয়েছে। ওদিকে থাইল্যান্ড-জাপানেও একইভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। থাইল্যান্ডে অনলাইনে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। পরীক্ষার সময় ল্যাপটপের ক্যামেরায় শিক্ষার্থীদের ভিডিও করা হচ্ছে।

তাহলে বাংলাদেশে অনলাইনের ক্লাসে সমস্যা কোথায়? প্রথমেই যদি বলি, বাংলাদেশে ফোর জি নেটওয়ার্ক বিস্তৃত নয়। আমাদের অর্থনৈতিক জীবন ব্যবস্থা অনলাইনের পাঠদানের সাথে ততটা অনুকূলে নয়। মুঠোফোন পরিসেবা গ্রহণ ব্যয়বহুল। তাহলে কি এভাবেই শিক্ষা কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়বে? তবে যেখানে সমস্যা আছে সেখানে সমাধানও আছে। টেলিকম কোম্পানিগুলো শিক্ষার্থীদের সিএসআর হিসেবে জিবি বিনা পয়সায় এই মহামারিতে দিতে পারে, সেই সাথে ইন্টারনেটের গতি বাড়াতে হবে। অনলাইনে যে পাঠদান করা হয় সেই ক্লাসটি ভিডিও করে রেখে পরবর্তীতে আপলোড করা যেতে পারে। যারা অংশগ্রহণ করতে পারবে না, তারা পরে ডাউনলোড করে নিতে পারে। তাছাড়া দীর্ঘদিন শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে তাদের লেখাপড়ার মনোযোগ ঘটাতেও সমস্যা হবে। তাই শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের মানসিক যোগাযোগ রাখাটাও জরুরি বলে আমি মনে করি।

তাছাড়া পৃথিবীখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে ডিগ্রি প্রদান করছে। অনলাইনের শিক্ষাকে ব্যক্তিবিশেষের স্বতন্ত্র করার জন্য এডুটেনমেন্ট বা গেমিফিকেশনের মাধ্যমে অনলাইন শিক্ষায় আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করা যেতে পারে। এখনই সময় ডিজিটাল উদ্ভাবনীমূলক দক্ষতাভিত্তিক পাঠ্যসূচি তৈরি করা। আমাদের ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থার বিষয়ে জনসচেতনতা এবং সমাজ সংস্কার এবং মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে প্রথম তথ্যপ্রযুক্তির গোড়াপত্তন করেন। তার সময়ে বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন পাবর্ত্য চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এই ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র সারাবিশ্বের সাথে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের যোগাযোগের সুদূরপ্রসারী ভিত্তি রচনা করে। আজকে বাংলাদেশের প্রথম ভূ-স্থির যোগাযোগ ও সম্প্রচার উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর ভিত্তি রচিত হয়েছিল বেতবুনিয়া থেকেই। বর্তমানে বাংলাদেশ ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশের তালিকায় যোগ হয়েছে বাংলাদেশ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ১৯৩টি দেশের মধ্যে ই-গভর্নমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১১৫তম স্থান দখল করেছে এবং ০.৪৮৬২ স্কোর অর্জন করেছে। বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে সরকারি সেবা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। নতুন কাজে ডিজিটাল মুদ্রা ব্যবস্থা ব্লকচেইন প্রযুক্তি চালু করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ব্লকচেইন বিশ্বজুড়ে তথ্য আদান প্রদানের অপরিবর্তনীয় এবং নিরাপদ মাধ্যম। এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০২১-২০২৩ সালের মধ্যে সারাদেশে ৫জি ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়ার কথা অঙ্গীকার করা হয়েছে। সেই সূত্র ধরে মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর, উপজেলা, জেলা, বিভাগসহ ১৮ হাজার ৪৩৬টি সরকারি অফিসকে একীভূত নেটওয়ার্কে সংযুক্ত করা হয়েছে। সরকারিভাবে জাতীয় ডাটা স্টোর স্থাপন করা হয়েছে। সারাদেশে প্রায় ৩৫শ’ মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম এবং ১২৯টি বিশেষায়িত ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। আইসিটি ইন এডুকেশন মাস্টার প্ল্যানের (২০১২-২০২১) আওতায় বিশাল জনগোষ্ঠী একুশ শতকে ডিজিটাল শিক্ষায় শিক্ষিত হবে।

গত ২৫ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শুদ্ধাচার চর্চার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিজিটাল সমন্বিত ব্যবস্থার কথা বলেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। তারই ধারাবাহিকতায় ২২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উদ্যোগে ‘ডিজিটাল সার্ভিস অ্যান্ড প্লানিং ল্যাব’র অনুষ্ঠান হয়। রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে সেই অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি উপস্থিত ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল ইন্টিগ্রেটেড ইউনিভার্সিটি ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট প্লাটফর্ম এবং ইউনিভার্সিটি ইউনিফর্ম ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের বিষয়ে রিপোর্ট প্রদান করা। ওই রিপোর্টটি তৈরি করতে ৩৬ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের বিশেষজ্ঞ সাতদিনব্যাপী কর্মশালায় অংশ নেন। সেই কর্মশালা থেকে বেরিয়ে আসে কিছু তথ্য, যেমন- ৬৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সফটওয়্যার সিস্টেম রয়েছে, ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সফটওয়্যার আপগ্রেড করতে হবে এবং ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তনে দুর্বলতা রয়েছে। কর্মশালায় একটি সফটওয়্যার প্রবর্তনের কথা সুপারিশ করা হয় যে, সফটওয়্যার দিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের ফলাফল এবং সনদপত্র সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করবেন। সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সংক্রান্ত বিষয়েও সফটওয়্যার থাকবে। এরই প্রেক্ষিতে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব, শিক্ষা কার্যক্রম, ফলাফল এবং ব্যবস্থাপনা সমন্বিত ব্যবস্থা উন্নয়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী মোস্তফা জাব্বারের ‘শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবহারের সুবিধা ‘ বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় প্রদত্ত বক্তব্যটি আজ ভীষণ মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আজকাল কেউ যদি নিজেকে তথ্য প্রযুক্তির বাইরে রাখেন বা ডিজিটাল শিক্ষায় অনাগ্রহ প্রকাশ করেন তবে নিশ্চিতভাবে তিনি পিছিয়ে পড়েছেন। একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রাথিমিক স্তর থেকেই শিক্ষায় ডিজিটাল রূপান্তর অপরিহার্য। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার মান বৃদ্ধিতে শিক্ষকদের অবশ্যই ডিজিটাল শিক্ষা ভালোভাবে আয়ত্ত করতে হবে। তা না হালে যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে একধাপ পিছিয়ে পড়বে শিক্ষার্থীরা।’

এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, দেশে সক্রিয় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটি ৮১ লাখ। ওয়াইম্যাক্স গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। তারের মাধ্যমে সার্ভিস প্রোভাইডারের সেবা গ্রহণকারী সংযোগ এখন ৫৭ লাখ ৩৫ হাজার। এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের জন্য এই অতিমারিতে ফ্রি পরিসেবা প্রদান করা টেলিফোন অপারেটরদের জন্য তেমন কোনো বিষয় নয়। সত্যি কথা বলতে, করোনা মহামারিতে সকল সেক্টরে ব্যবসা বাণিজ্যে ধ্বস নামলেও টেলিফোন কোম্পানির কোনো লোকসান গুনতে হয়নি। সুতরাং সিএসআর হিসেবে টেলিফোন কোম্পানিগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা পয়সায় জিবি প্রদানের বিষয়টি সুবিবেচনায় রাখতে পারে।

১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল ছাত্র ইউনিয়নের ত্রয়োদশ কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের শিক্ষা হবে গণমুখী শিক্ষা’। এই বক্তব্যটি নিয়ে ভাবনার মোক্ষম সময় এটি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী, যারা এখন প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তারা যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করবে সে সময় বর্তমানের মতো থাকবে না। তাছাড়া এই মহামারির সাথে আমাদের অনেকদিন বাস করতে হবে। তাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে অনলাইনে পাঠদান নিয়ে ভাবনার সময় এখনই। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব দরজায় কড়া নাড়ছে । এর মধ্যে করোনাভাইরাস আমাদের সতর্ক করে দিল। আমাদের তথ্যপ্রযুক্তিতে আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। নইলে করোনাভাইরাসের এই মহামারিতে দিনের পর দিন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে থাকলে শিক্ষার্থীরা চরম ক্ষতির মধ্যে পড়ে যাবে। বৃহৎ অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রিয় দেশ বাংলাদেশ।

লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান, লোক প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ জাগোনিউজ২৪

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত