বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

12958

Published on জুন 22, 2020
  • Details Image

মোহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম রাসেলঃ

পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। ‌পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ঢাকার ১৫০ মোগলটুলীতে অবস্থিত মুসলিম লীগের ওয়ার্কশসপ ক্যাম্পের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব ছিলেন টাঙ্গাইলের শামসুল হক। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে এখানকার মুসলিম লীগের তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরা এক সম্মেলনের আয়োজন করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্বের কাছে একটি প্রতিনিধি দল পাঠায়। এ প্রতিনিধি দল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সভাপতি চৌধুরী খালেকুজ্জামানের কাছে পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ নেতৃত্বের ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপন করেন। কিন্তু মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগের সভাপতি আকরাম খাঁ এবং নাজিমুদ্দিন প্রমুখকে জোরলোভাবে সমর্থন করে। এতে পূর্ব বাংলার প্রতিবাদী ও তরুণ মুসলিম লীগ কর্মীরা খুবই ক্ষুদ্ধ হন। তাছাড়া পাকিস্তানের যাত্রা শুরুর পর থেকে সরকার আমলা নির্ভর হয়ে পড়ে। ফলে জনগণের সাথে সরকারের দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ছাড়াও আমলারা ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে অবস্থা করে নেয়। জিন্নাহ্ গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারত বা ব্রিটেনের মত নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান না হয়ে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতার মালিক হন। রাজনীতিবিদদের তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি রাজনীতিবিদদের কার্যকলাপের উপর নজরদারি করতে আমলাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

পরবর্তী গর্ভনর লিয়াকত আলী খানও একই স্বভাবের ছিলেন। ফলে অন্তর্দলীয় কোন্দল প্রবল আকার ধারণ করে এবং মুসলিম লীগের কার্যকলাপ, ভাষা-সংস্কৃতির উপর আক্রমণ, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পূর্ববাংলার দূর্ভিক্ষ, সাধারণ জনজীবনে বিপর্যয় ইত্যাদি ঘটনাবলি মুসলিম লীগের তরুণ অংশকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। দেশ পরিচালনায় মুসলিম লীগ সরকারের ব্যর্থতা, রাজনৈতিক দমননীতি শিক্ষিত সমাজকে দারুনভাবে হতাশ করে৷ এচাবে পূর্ব বাংলার সামগ্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে পূর্ববঙ্গের অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল রাজনীতিবিদগণ একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা করেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন কাজী বশিরের স্বামীবাগস্থ বাসভবন "রোজ গার্ডেন" এ অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের মাধ্যমে "পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ" গঠিত হয়। পূর্ব বাংলা সরকারের এডভোকেট জেনারেল এ কে ফজলুল হকও সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। নব গঠিত দলের সভাপতি হন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক পদে শামসুল হক, যুগ্ম সম্পাদক পদে শেখ মুজিবুর রহমান আসীন হন। এ রাজনৈতিক দলের ঘোষণা পত্র এবং গঠনতন্ত্রের ভূমিকায় মুসলিম লীগ সরকারের দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা করা হয়। মুসলিম লীগ নেতৃত্বের ক্ষমতালিপ্সা, অগগনতান্ত্রিক মনোভাব ও দমন-পীড়নের কঠোর সমালোচনা করে জনগণের দরিদ্রতা দূরীকরণ, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় জনমতের সঠিক প্রতিফলনকল্পে একটি রাজনৈতিক দলের বাস্তব ও সময়োপযোগী প্রয়োজন থেকে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়।

এ রাজনৈতিক দল পূর্ব বাংলার মানুষের আর্থ-সামাজিক সমস্যাবলীকে সামনে রেখে কর্মসূচি প্রণয়ন করে। জমিদারি প্রথার বিলোপ, বৃহৎ শিল্পের জাতীয়করণ, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ পাটের ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্প্রসারিত করা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি প্রভৃতি এ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। সরকারী বৈরিতা এবং দমন-পীড়ন সত্ত্বের নবগঠিত এ রাজনৈতিক দল পূর্ব বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে আর্বিভূত হয়।

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর এই দেশে মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা পালনের মাধ্যমে এটি পূর্ব বাংলার একক ও নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের মধ্যেও রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল এই দুই ধারার রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। রক্ষণশীল অংশ মুসলিম লীগের ন্যায় গতানুগতিক ধারায় রাজনীতি করার পক্ষে মত দিলেও প্রগতিশীল অংশ সামন্তবাদ-সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক দল গঠনের পক্ষে ছিলেন। তাই তারা দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ করার পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু রক্ষণশীল অংশের বিরোধিতার কারণে পার্টির একতা বজায় রাখতে মাওলানা ভাসানী' 'মুসলিম' শব্দটি রেখেই দলের নামকরণ করেন।তাছাড়া কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করতে, মুসলিম শব্দযুক্ত বিরোধী দলের প্রয়োজন ছিল। পূর্ব বাংলার আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা, শিক্ষিত শ্রেণীর মননলোকের পরিবর্তন ধারা,ভাষাভিত্তিক জাতীয়বাদ প্রভৃতি মৌলিক প্রপঞ্চসমূহকে ধারণ করার মধ্য দিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ একটি অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত হওয়ার অভিপ্রায়ে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হয়। তবে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ দলের নাম থেকে "মুসলিম" শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নামকরণ শুধু আওয়ামী লীগের ইতিহাসেই নয়, এদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসেও একটি মৌলিক পরিবর্তনের সূচক। ১৯৫৫ সালের ২১ - ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২২শে সেপ্টেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দী দলের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব করলে সর্ব সম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়। ফলে ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের লোক আওয়ামী লীগে যোগদানের মধ্য দিয়ে এটি একটি সেকুলার ও সর্বজনীন রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কাউন্সিলর অধিবেশনের ৩য় দিন শেষে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি ও শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদ গঠিত হয়।

আওয়ামী মুসলিম লীগের উত্থান প্রতিহত করতে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ আগ্রাসী স্বৈরাচারী পন্থা অবলম্বন করে। পূর্ব বাংলা মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য মুসলিম লীগ ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে। এতে হিন্দু সম্প্রদায় ব্যাপকভাবে দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যায়। এইভাবে একটি বড় সমর্থক গোষ্ঠী হারিয়েও আওয়ামী লীগের অগ্রযাত্রা ব্যাহত না হয়ে বরং কেন্দ্রীয় সরকারের দূর্নীতি ও অনাচারের ফলে পূর্ব বাংলায় যে বিক্ষোভের দানা বাদে তাই দলের রাজনৈতিক প্রসারের পক্ষে সহায়ক হয়।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালে শরীফ শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন ও ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ও তার দল আওয়ামী লীগ স্বোচ্চার ছিলেন। ১৯৬৫ সালে সংগঠিত পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে ১৯৬৬ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে ৬দফা কর্মসূচী উত্থান করেন। ১৯৬৬ সালের ৮ই মে নারায়ণগঞ্জে কয়েকজন সঙ্গী সহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। এতে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হন। বাঙালির প্রান প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য তাঁর বিরুদ্ধে আগরতলা মামলা দায়ের করে। কিন্তু জনগণের চাপের মুখে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্ধীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালে ঐতিহাসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগের সংখ্যাধিক্য থাকা সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলি ভুট্টোর ইচ্ছাকে প্রধান্য দিয়ে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ১লা মার্চ এক ঘোষণা জারির মাধ্যমে ৩মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষনা করেন। ১৯৭১ সালে ৭মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জন সমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম"। ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, অত্যাচার, নিপীড়ন, ধর্ষণ, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ, গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশ স্বাধীন ঘোষণা করেন।দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, ত্রিশ লক্ষেও অধিক শহীদ, তিন লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হানির বদৌলতে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অভ্যুদয় ঘটে।

লেখকঃ সাবেক সদস্য, প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত