বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা আন্দোলনের ইতিহাস

2127

Published on জুন 9, 2020
  • Details Image

নিশিকান্ত রায়ঃ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতির এক মহাকবি। তাঁর তৃতীয় নয়ন সৃজনশীল নয়ন। ছয় দফা তাঁর তৃতীয় নয়নে দেখা মুক্তির ফুল। স্বপ্ন পূরণের ঐতিহাসিক পথরেখা। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের দেশভাগের পর থেকে জনগন ও রাজপথ তাঁর প্রিয়জন হয়ে উঠে। তিনি বুঝতে পারেন তাঁদের মনের ভাষা। রাজনীতি মানে যে শ্রেষ্ঠনীতি সেটা তিনি স্বপ্নে ও কর্মে বাস্তবে পরিণত করেন।

তাঁর রাজনীতির মহাকাব্যের একটি কবিতার নাম " ছয় দফা।" সে কবিতার মূল চরণ একটু খানি দেখা যাকঃ-

(১) শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি।

(২) কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা।

(৩) মুদ্রা ও অর্থ সম্বন্ধীয় ক্ষমতা।

(৪)  রাজস্ব, কর,বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা।

(৫)  বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা।

(৬)  আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে শোষন, নিপীড়ন ও বৈষম্যের আলোকে বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা জনগণেরই মনের কথা। অর্থাৎ মাতৃভাষার আন্দোলন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং ১৯৬৫ খ্রিঃ পাক ভারত যুদ্ধ থেকে পাওয়া বঞ্চনা বঙ্গবন্ধুকে চিনিয়ে দেয় পথ। তিনি এগিয়ে যান। ওই যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা বলতে কিছুই ছিল না। আর অর্থনৈতিক বৈষম্য সেতো আকাশ পাতাল যেন হার মানায়। বৈষম্যের এক টুকরো পরিসংখ্যান  দেখা যেতে পারেঃ-

বছর

 

পশ্চিম পাকিস্তানে

ব্যয়  ( কোটি রূপি )

পশ্চিম পাকিস্তানে

ব্যয়

(মোট শতাংশ)

পূর্ব পাকিস্তানে

ব্যয়

(কোটি রূপি)

পূর্ব পাকিস্তানে

ব্যয়

(মোট শতাংশ)

% জনসংখ্যা

 

 

৩৬.২৩

 

৬৩.৭৭

১৯৫০-৫৫

 

১১২৯

৬৮.৩১

৫২৪

৩১.৬৯

১৯৫৫-৬০

 

১৬৫৫

৭৫.৯৫

৫২৪

২৪.০৫

১৯৬০-৬৫

 

৩৩৫৫

৭০.৫

১৪০৪

২৯.৫০

১৯৬৫-৭০

 

৫১৯৫

৭০.৮২

২১৪১

২৯.১৮

মোট

 

১১৩৩৪

৭১.১৬

৪৫৯৩

২৮.৮৪

ফলে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন একটি বড় ইস্যু হয়ে উঠে। তিনি অনুভব করেন দুর্বার গনআন্দোলনের। শোষণ,পাহাড় সমান বৈষম্য ও নিরাপত্তাহীনতার কথা জনগণকে জানাতে থাকেন বক্তৃতা এবং বিবৃতিতে। ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৬ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। রাষ্ট্রবিরোধী বক্তৃতার অভিযোগে তাঁকে এক বছরের জেল দেয়া হয়। হাইকোর্টে আপিল করে অন্তর্বর্তী জামিন পান তিনি। তাঁর চিন্তা চেতনায় আসে পরিবর্তন। স্বায়ত্তশাসন আদায় জরুরি হয়ে পড়ে। দ্রুতই প্রণয়ন করেন ছয় দফা দাবী। তাসখন্দ চুক্তির বিরোধিতার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে কনভেনশন হয় ১৯৬৬ সালের ০৫ ও ০৬ ফেব্রুঃ। কনভেনশনে বিরোধী দলের প্রতিনিধি ছিল ৭৪০ জন। তার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ২১জনের মাত্র ১০জন ছিলেন আওয়ামী লীগের। কনভেনশনে বঙ্গবন্ধু  'ছয় দফা' উপস্থাপন করেন দৃঢ়তার সঙ্গে। আওয়ামী লীগ বাদে অন্যরা প্রস্তাবকে নাকচ করে দেন। বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদ করেন তীব্রভাবে। সন্মেলন ত্যাগ করে ফিরে আসেন ঢাকায় ১৯৬৬ সালের ১১ ফেব্রুঃ। পশ্চিম পাকিস্তানের পত্র পত্রিকা ছয়দফা'র বিবরণ ছাপিয়ে শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আখ্যায়িত করেন। পত্রিকার খবরে আওয়ামী লীগের কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হন। এক আধটু দ্বিধাবিভক্তিও লক্ষ্য করা যায়। এতদসত্বেও পার্টির ওয়ার্কিং কমিটির সভা ছাড়াই "বাঙালির দাবী ৬-দফা", "বাঁচার দাবী ৬-দফা ", "৬-দফার ভিতরেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন নিহিত" ইত্যাদি পোস্টারে দেয়াল ছেয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ২১ফেব্রুঃ ১৯৬৬ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ৬-দফার প্রস্তাবনা অনুমোদিত হয়। এদিন হতেই ৬-দফা আওয়ামী লীগের ইস্তেহারে পরিনত হয়। ঘোষিত হয় আন্দোলনের কর্মসূচি। তৎকালীন সভাপতি মওলানা আব্দুর রহিম তর্কবাগীশ ও কিছু প্রবীণ নেতা ৬-দফার বিরোধিতা করেন।

১৮ ও ১৯ মার্চ ১৯৬৬ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ৬-দফা অনুমোদিত হয়। গঠন করা হয় নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি। সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দিন আহমেদ। শেখ মুজিবুর রহমানের নামে কাউন্সিলেই প্রকাশ করা হয় "আমাদের বাঁচার দাবীঃ ৬-দফা কর্মসূচি " শিরোনামে একটি পুস্তিকা। ৬-দফা জনগণকে জানাতে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ শুরু করেন গণসংযোগ। বঙ্গবন্ধু নিজেই ২০ মার্চ থেকে ০৮ মে ১৯৬৬ পর্যন্ত ৫০ দিনে ৩২ টি জনসভা করেন।

ফলে অতি দ্রুত জনমত তৈরি হতে থাকে। ছাত্রলীগের নেতারাও সম্পৃক্ত হয়ে যায় সরাসরি ভাবে। ছাত্র ইউনিয়নের সহায়তায় পঞ্চাশ হাজার লিফলেট ছাপিয়ে বিতরন করা হয় সেসময়েই। ন্যাপের যে অংশ ৬-দফার পক্ষে ছিল তাঁরা দৈনিক সংবাদ পত্রিকার প্রেস থেকে লিপলেট ছাপিয়ে দিতেন। সারাদেশে ৬-দফার আন্দোলন তুঙ্গে। শুরু হয় সরকারি দমন পীড়ন। এপ্রিল ১৯৬৬'র মধ্যে রাষ্ট্র বিরোধী বক্তৃতার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে জেলায় জেলায় বারোটির বেশি মামলা করা হয়। ২০ মার্চ ১৯৬৫ পল্টন ময়দানে রাষ্ট্র বিরোধী ভাষনের অজুহাতে বঙ্গবন্ধুকে যশোর থেকে গ্রেফতার করা হয় ১৮ এপ্রিল ১৯৬৬ ভোর রাতে। মিছিলে শ্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠে সারাদেশ। তাঁকে স্হায়ীভাবে বন্দী করার কুমতলব আঁটে সরকার। ০৮ মে ১৯৬৬ দেশরক্ষা আইনে শেখ মুজিবকে আটক করে ২২ ফেব্রুঃ ১৯৬৯  পর্যন্ত একটানা ৩৩ মাস কারাগারে রাখা হয় । বঙ্গবন্ধুর ১৪ বছরের কারাজীবনে এটাই দীর্ঘ কারাবাস।

এই দীর্ঘ সময়ে ৬-দফার আন্দোলন আরও তীব্রতর হতে থাকে। দমন পীড়নের মাত্রা বেড়ে যায়। ওই সময়ে প্রায় ১৩০০০ নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ০৭ জুন ১৯৬৬ হরতাল চলাকালে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ১০জন।

গ্রেফতার হন দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। নিষিদ্ধ করা হয় ইত্তেফাক এবং বাজেয়াপ্ত করা হয় নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস। চলতে থাকে হরতাল, অবরোধ। অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে দেশ।বঙ্গবন্ধু কারাগারে কিন্তু আন্দোলন গতিময়। বঙ্গবন্ধুর  ৬-দফার সাথে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফা যুক্ত হয়। সর্বস্তরের মানুষ সরাসরি অংশ নেয় কর্মসূচিতে।  লাগাতার আন্দোলনে বেসামাল হয়ে পড়ে শাসকদল। মিছিলে পুলিশের গুলিতে ঢাকাতেই নিহত হন ছাত্র মতিউর রহমান,ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান। সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন তিন জন এবং আহত হন অনেক নেতা কর্মী। গ্রেফতার হন প্রায় তের হাজার জন । সেনাবাহিনীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে বেয়োনেট চার্জে হত্যা করে । এতে কয়েকজন ছাত্র ও অধ্যাপকও আহত হন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে আগরতলা ষড়যন্ত্রের নামে অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করে হত্যা করে স্বৈরাচারী সেনারা। গোটা দেশ গণরোষে জ্বলে উঠে।  গণদাবী ও লাগাতার আন্দোলনের  মুখে ২২ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ বঙ্গবন্ধু সহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত সবাইকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার। মুক্ত হয়েই বঙ্গবন্ধু ৬-দফা নিয়ে আরও সোচ্চার হয়ে উঠেন। ডাক দেন আপোষহীন আন্দোলনের। ৬-দফার সাথে ছাত্রদের ১১-দফা মিলে দুর্বার গণ আন্দোলন স্বৈরশাসকের গদিকে করে দেন নড়বড়ে। আন্দোলন গণ অভ্যুত্থানে রুপ নেয়। স্বৈরাচারী আইয়ুবের পতন ঘটে। ৬-দফার মাধ্যমে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন স্বাধিকারের সংগ্রামে রুপান্তরিত হয়। দেশের সর্বস্তরের মানুষ নেমে আসে রাজপথে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণকালে জনাব তোফায়েল আহমেদ বলেন, " ছয় দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, --"সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।" বস্তুত ছয় দফা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র বা অংকুর।

জনাব তোফায়েল আহমেদ আরও বলেন যে বঙ্গবন্ধু তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, তিনি ছয় ' দফা' না দিলে আগরতলা মামলা হতো না, এই মামলা না হলে গণ অভ্যুত্থান হতো না, এই গণ অভ্যত্থান নাহলে তাঁকে কারাগার থেকে মুক্ত করতে পারতাম না। আর তিনি মুক্ত না হলে সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী হতাম না।

আর তিনি যদি বিজয়ী না হতেন, তাহলে আমরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করতে পারতাম না।

লেখকঃ সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, লালমনিরহাট জেলা শাখা

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত