বাঙালির 'ছয় দফা'

1905

Published on জুন 9, 2020
  • Details Image

পীযূষ কান্তি বড়ুয়াঃ

পৃথিবীর ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস। পৃথিবীর ইতিহাস আন্দোলনের ইতিহাস। যৌক্তিক সংগ্রামই পেরেছে পৃথিবীকে বদলাতে এবং বদলে দিতে। সংগ্রামে আজন্মসিদ্ধ বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মস্তিষ্কজাত মুক্তির অনন্য সনদ ছয়দফা বাঙালির কেবল বাঁচার দাবি ছিল না, এ ছিল সত্যিকার অর্থেই পৃথিবীর তাবৎ শোষিতের মুক্তির জীনমানচিত্রের নকশা। কোন জীবাণুর জীন নকশার উন্মোচন যেমন আমাদের সামনে সেই জীবাণুকে মোকাবেলার অপার দিগন্ত খুলে দেয় তেমনি মহানায়কের ছয় দফাও পৃথিবীকে এনে দিয়েছে শোষিতের মুক্তির সেই সবখোল চাবিটিকে।

নিরন্তর শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট বাঙালি যখন সামরিক শাসনের তাণ্ডবে মুক্তির জন্যে ত্রাহি মধুসূদনরূপে কেঁদে উঠেছিলো ঠিক তখন বাঙালি জাতির স্বাধীনতার মহানায়কের মস্তিষ্কে জন্ম নিলো আমাদের মুক্তির আলোক রেখা তথা ঐতিহাসিক ছয়দফা। একটা আন্দোলনকে নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে ধাবিত করে সাফল্য ছিনিয়ে আনতে হলে দরকার হয় হাতিয়ারের। হাতিয়ারবিহীন কোন যোদ্ধাই যুদ্ধক্ষেত্রে লড়ে যেতে পারে না। সে যত বড় যোদ্ধাই হোক। রাজপথের সংগ্রামে লড়ে যেতে হলে ছয় দফার মতো এক ঐতিহাসিক হাতিয়ার অনিবার্য ছিলো। এই ছয় দফা এমন এক হাতিয়ার ছিল যা সবার জন্যেই এক ও অদ্বিতীয়। এই হাতিয়ার এমন এক অহিংস হাতিয়ার যার দ্বারা কোন রক্তপাতের আশঙ্কা ছিল না কিংবা ছিল না কোন সশস্ত্র মোকাবেলার আতঙ্ক। এই ছয় দফা হাতিয়ার যেন এক মহাভারতের ব্রহ্মাস্ত্রের মতোই কার্যকর। এক ব্রহ্মাস্ত্র যেমন মুহূর্তেই লাখো অস্ত্রে পরিণত হয় তেমনি ছয় দফাও বাঙালির কণ্ঠে লক্ষ লক্ষ অস্ত্র রূপে প্রকাশিত হয়েছে রাজপথের রণক্ষেত্রে।

ছয়দফাকে শাণিত করতে এর জনক শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রচারণায় ঘুরে বেরিয়েছেন বাংলার আনাচে কানাচে। উত্তরবঙ্গ-দক্ষিণবঙ্গ কিংবা পূর্ববঙ্গে তিনি সফর করে ছয়দফাকে শক্তি প্রদানে ব্যাপক শ্রম বিনিয়োগ করেছেন। মহাভারতে যেমন অর্জুন অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া নিয়ে পুরো রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন তেমনি করেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তাঁর মেধাজাত সন্তান ছয়দফাকে নিয়ে ঘুরেছেন বাংলার আনাচে কানাচে। এভাবে জনতার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে ছয়দফা বিপুল শক্তি অর্জন করে এবং তখন তা সত্যিকার অর্থেই অশ্বমেধজ্ঞের ঘোড়ার মতো বিশ্বজয়ী হয়ে যায়। এই ছয়দফার জন্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঊনিশশো ছেষট্টি সালের কয়েক মাসে প্রায় এগার বারের মতো কারাবরণ করতে হয়। এ থেকেই বুঝা যায়, ঊনিশশো ছেষট্টিতে শেখ মুজিবুর রহমানের চেয়ে তাঁর উদ্ভাবিত ছয়দফাই ছিলো স্বৈর শাসক আইয়ুব খানের কাছে অধিক বিপজ্জনক। সমরবিদ্যায় পারদর্শী আইয়ুব খান ঐ উত্তাল সময়ে ঠিকই তার মূল শত্রু চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। আর এ কারণেই তিনি চাননি ছয়দফা আমজনতার কাছে জনপ্রিয়তা পাক। তিনি ছলেবলে কলে-কৌশলে ছয়দফাকে তার অগ্রযাত্রায় বাধা দিতে চেয়েছিলেন। ছয়দফাকে কেন্দ্র করে আহূত আওয়ামী লীগের হরতাল যাতে বানচাল হয় তার জন্যে আইয়ুবশাহী শেখ মুজিবুর রহমানকে আটকে রাখে জেলে। শুধু তাই নয়, সাতই জুনের আগের রাতে ধরে ধরে নিরীহ কর্মীকে তারা কারাগারে আটকে জেল ভরিয়ে তোলে।

আইয়ুবশাহী এতে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর স্বস্তি লাভের বোকামি করলেও জনতা বোকামি করেনি। জনতা ঠিকই সেদিন ভোর হতে শান্তিপূর্ণ হরতালে সক্রিয় ছিল। অর্থাৎ অশ্বমেধ যজ্ঞের বিশ্বজয়ী ঘোড়ার মতোই, জনককে কারান্তরালে রেখেও তাঁর সৃষ্টি পেয়ে গেছে সর্বজয়ী শক্তি। ফলে আইয়ুবশাহীর পতনের পথ হয়েছে ত্বরান্বিত। সমরে যে প্রথমে মেজাজ হারায় তার পরাজয় অনিবার্য। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে ফিল্ড মার্শালের তকমাধারী আইয়ুব বাংলার রাখালরাজার কৌশলের কাছে হয়েছে পরাস্ত। রাখাল রাজার সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র ছয়দফাকে ভয় পেয়ে আইয়ুবশাহী একের পর এক মহাভুল করে চলেছিল। যদি সেদিন এই ভুলগুলো করা না হতো তবে আজ ইতিহাস কিঞ্চিৎ ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হতো। কিন্তু শেখ মুজিব তাঁর ছয়দফাকে এমনভাবে শক্তিমত্তা দিয়েছিলেন যে তা আইয়ুবের মনে যথেষ্ট ভয়ের সঞ্চার করে। এরই পরিণতিতে তিনি ছয়দফাকে বাধা দেওয়ার বিফল প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন।

ছয়দফা হাতিয়ারটির গভীরতা অনেকের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব ছিলো না। ছয়টি দফার মধ্যে প্রতিটি দফাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সুচিন্তিত। যেহেতু তখনও পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অধীনে ছিলো, সেহেতু তখনই বাংলাদেশকে স্বাধীন বলার কোন সুযোগ ছিলো না। কিন্তু মুজিব বায়ান্ন সালের কারাবন্দিতা থেকেই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে আসছিলেন। অর্থাৎ ছয় দফার প্রথম দফাতে তিনি সুদূরের প্রজ্ঞা দিয়ে স্বাধিকার ও স্বায়ত্ব শাসনের দাবি করলেও মনের ভিতরে তাঁর প্রোথিত ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ। এ কারণেই তিনি একাত্তরের অগ্নিঝরা বিকেলের সাত মার্চে মহাকাব্যিক ভাষণে জয় বাংলাদেশ না বলে জয় বাংলা বলেছিলেন। যাতে তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কোন রকমের বিদ্রোহের অভিযোগ না তুলতে পারে। একবার যদি পশ্চিম পাকিস্তানের বিদ্রোহের অভিযোগ প্রতিষ্ঠা করা যেত তবে শেখ মুজিবের সামরিক আদালতে ফাঁসি হতো এবং বাংলাদেশের স্বপ্ন ভেঙে খান্ খান্ হয়ে যেত।

অথচ এই ছয়দফাকে হৃদয় দিয়ে এবং মস্তিষ্ক দিয়ে অনুধাবন করতে না পারার কারণে কিছু আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রনেতারা এর বিরুদ্ধে আটদফা নামে এক ভঙ্গুর রাজনীতিকে দাঁড় করান। সে সময়ে যদি বেগম মুজিব এবং তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা তথা আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শক্ত অবস্থান গ্রহণ না করতেন তবে আজ ছয়দফাকে নিয়ে এগিয়ে আসা যেত না। জেলে মুজিবের সাথে দেখা করতে গেলে মেয়ের ভাষায় টেপ রেকর্ডার, অসম্ভব মেধাবী মহীয়সী বেগম মুজিব পই পই করে শেখ মুজিবের কাছে নেতাদের এই নেতিবাচক অবস্থানের কথা তুলে ধরতেন এবং মুজিবকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে আট দফাকে বাতিলের জন্যে মত প্রকাশ করেন। প্রাজ্ঞ মুজিব স্ত্রী ও কন্যার অনমনীয়তা ও দূরদর্শিতাকে অভিনন্দিত করে নিজের মহান আবিষ্কার মহান ছয়দফার প্রতি তাঁর সর্বাত্মক আস্থা অটুট রাখেন।

ছয়দফা যে কেবল হাতিয়ার ছিলো তা নয়। ছয়দফা ছিল বাঙালি জাতির প্রাণ স্পন্দন। পরাধীনতার অন্ধকার গুহায় যখন বাঙালি হয়েছিল দিশেহারা, তখন এই ছয়দফাই ছিল এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।

দেশে ও বিদেশে ছয়দফার পক্ষে জেগে ওঠা জনমতই বাঙালিকে এগিয়ে দিয়েছে মহান মুক্তি সংগ্রামের দিকে। ছয়দফায় যেমন রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সামরিক বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে তেমনি এর মাধ্যমে বাঙালির আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও বেশ পরিপক্কতার সাথে বিকশিত হয়েছে। বিশ্বজনমতকে নিজের পক্ষে আনতে ছয়দফা ছিল আমাদের আন্তর্জাতিক এক বিশেষ দূতের মতো। ছয়দফা বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল, রাষ্ট্রক্ষমতার চেয়ে বাঙালির কাছে আত্মমর্যাদার প্রশ্নটি বড়। বাঙালি কখনো নিজের আত্মমর্যাদা বিকিয়ে দিয়ে যেমন শাসনক্ষমতা চায়নি তেমনি নিজেদের অধিকারের জন্যে বাঙালি নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতেও পিছপা হয়নি। শেখ মুজিবের ছয়দফা তাই একদিকে মুক্তি সনদ আর অন্যদিকে বাঙালির আত্মমর্যাদার অনন্য স্মারক। ছয়দফার উপজাত শক্তি বাঙালিকে নিয়ে গেছে ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের দিকে, সত্তরের নির্বাচন ও বিজয়ের দিকে এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অর্জনের দিকে। ছয়দফা বাঙালির শক্তির অমৃতকুম্ভ। ছেষট্টি পরবর্তী সকল আন্দোলনে ছয়দফা আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে অগ্রসেনানী হয়ে। তাই আজকের বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ছয়দফা কেবল কোন সনদ নয় বরং মহাশক্তির আধার ছিল বলা যায়।

ছয়দফার আরো একটি উল্লেখযোগ্য উপজাত বলা যায় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সুনির্দিষ্ট পোশাকের প্রচলনের সুযোগ সৃষ্টি। আপাদমস্তক বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবীর সাথে মানানসই কালো কোট পরিধান করতেন যাকে মুজিবকোট নামে অভিহিত করা হয়। এই মুজিবকোটের বোতামের সজ্জায় ছয়দফাকে ধারণ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিজেদের পোশাক ¯^াতন্ত্র্যের পরিচয় তুলে ধরতে পেরেছে। ছয়দফার চেতনাধারী এই কোট ¯^াধীনতোত্তর সময়ে বাঙালিকে জাগিয়ে রেখেছে মুজিবীয় চেতনায়। আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশতবর্ষে সময় এসেছে, এই কোটটিকে জাতীয় পোশাকের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে আপামর বাঙালিকে ছয়দফার চেতনা ধারণ করার মানসিকতায় উজ্জীবিত করার। আমাদের জাতীয় পরিচয়ের সাথে অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে ছয়দফা গ্রন্থিত হয়ে থাকুক জাতির পোশাকে- এই হোক আজকের সর্বান্তঃকরণ আকাঙ্ক্ষা।

লেখকঃ চিকিৎসক, কবি, ছড়াকার ও প্রাবন্ধিক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত