বঙ্গবন্ধুর ছয়- দফা প্রণয়নের ইতিহাস

1636

Published on জুন 7, 2020
  • Details Image

মো. জাহিদুর রহমানঃ

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ঐতিহাসিক ছয়- দফা ছিল সকল রকম বঞ্চনা আর বৈষম্যের অবসান করে বাঙালি জাতির  বাচাঁর দাবি। পাকিস্তানের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাঙালি জাতির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ও শোষণ, রাজনৈতিক অধিকার হরণ, প্রতিটি ক্ষেত্রে বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। জনগণ কয়েক বছরের রাজনৈতিক ঘটনাবলিন মধ্যে দিয়ে যেটা স্পষ্টতভাবে বুঝতে পারে এবং সচেতন হয়ে ওঠেন। জনগণ ১৯৪৯ সাল থেকে স্বায়ত্বশাসনের দাবি শুরু করে। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে আইয়ুব খান তার বেআইনি দখলকৃত ক্ষমতাকে আইনসম্মত করার জন্য বিশেষ কায়দায় দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দেন। যেখানে জনগণের প্রত্যক্ষ কোনো ভোটাধিকার ছিল না। ভোট জালিয়াতি করে তিনি তার সিংহাসনকে পাকাপোক্তা করেন। নির্বাচনের পর থেকেই দেশের তৎকালীন সামরিক সরকারের সাথে বঙ্গবন্ধুর মতবিরোধ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন পুরোপুরি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তিঁনি চাইতেন দেশে প্রতিষ্ঠিত হোক একটি সত্যিকার ও নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। দেশের উভয় অংশের প্রতিটি মানুষ বাস করবে এই গণতান্ত্রিক পরিবেশে সুখে-শান্তিতে । তাদের মধ্যে দূর হবে সকল বিভেদ এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য। বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন পূর্ব বাঙালার মানুষের বিভেদ ও অর্থনৈতিক বৈষম্যেরই শিকারের করূণ চিত্র। যে বাঙালিরা শান্তি ও সুখের আশায় পাকিস্তানের জন্য জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করেছিল সেই স্বপ্নের পাকিস্তানেই তাদের স্বপ্নভঙ্গ করেছিল। এ সময় বাঙালিরা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে কিভাবে বঞ্চিত ও অবহেলিত হচ্ছিল তার কিছু চিত্র নীচে তুলে ধরা হলঃ

১। চাকরির ক্ষেত্রে

বাঙালি

অবাঙালি

কেন্দ্রীয় দফতর

৪২ টি পদ

৬৯২ টি পদ

শিল্পোন্নয়ন সংস্থা

৩ টি পদ

১৩২ টি পদ

রেডিও

১৪ টি পদ

৯৮ টি পদ

সরবরাহ ও উন্নয়ন

১৫ টি পদ

১৬৪ টি পদ

রেলওয়ে

১৪ টি পদ

১৫৮ টি পদ

পোস্ট ও টেলিগ্রাফ

৫০ টি পদ

২৭৯ টি পদ

কৃষি ও অর্থনৈতিক সাহায্য সংস্থা

১০ টি পদ

৩৮ টি পদ

জরিপ

২ টি পদ

৬৪ টি পদ

বৈমানিক  বেসামরিক)

৭৫ টি পদ

১,০২৫ টি পদ

সেক্রেটারি

১ টি পদ

৩ টি পদ

জয়েন্ট সেক্রেটারি

৮ টি পদ

২২ টি পদ

ডেপুটি সেক্রেটারি

২৩ টি পদ

৫৯ টি পদ

১ম শ্রেনীর গেজেটেড অফিসার

৮১১ টি পদ

৩৭৬৯ টি পদ

২য় শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার

৮৮৪ টি পদ

৪৮০৫ টি পদ

২য় শ্রেণীর নন গেজেটেড অফিসার

১,১৮০ টি পদ

৫৫৫১ টি পদ

৩য় শ্রেণীর নন গেজেটেড অফিসার

১৩,৭২৪ টি পদ

১,৩৭,৯৭৫ টি পদ

 

২. বিদেশি চাকুরির ক্ষেত্রে: ( ১৯৬৫ সালের হিসেবে)

বাঙালি

অবাঙালি

১ম শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার

৫৮ টি পদ

১৭৯ টি পদ

২য় শ্রেণীর গেজেটেড অফিসার

৪৮টি পদ

১৯৬ টি পদ

 

৩. সেনাবাহিনীতে পদ

বাঙালি

অবাঙালি

মেজর জেনারেল

পদ ছিল না

২০ টি পদ

ব্রিগেডিয়ার

১ টি পদ

৩৪ টি পদ

কর্নেল

১ টি পদ

৪৯ টি পদ

লেফটেন্যান্ট কর্নেল

২ টি পদ

১৯৮ টি পদ

মেজর

১০ টি পদ

৫৯০ টি পদ

নৌবাহিনী অফিসার

৭ টি পদ

৫৯৩ িিট পদ

বিমানবাহিনী

৪০ টি পদ

৬৪০ টি পদ

 

৪. সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (১৯৬৮) সালের হিসাব)

বাঙালি

অবাঙালি

মাধ্যমিক

৯০ টি পদ

৬৫৩ টি পদ

কলেজ

৩১ টি পদ

১১৪ টি পদ

 

৫.শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ( ১৯৫৫ সালের হিসেবে):

পূর্ব পাকিস্তান

পশ্চিম পাকিস্তান

নতুন কলেজ

০ টি

১ টি

পুরোনো কলেজ

৬৫ টি

৭৬ টি

মেডিকেল কলেজ

১ টি

৬ টি

প্রকৌশল কলেজ

১ টি

৩ টি

বিশ্ববিদ্যালয়

২ টি

৪ টি

প্রাইমারি স্কুল

২,২১৭ টি

৬,২৪৬ টি

মাতৃসনদ

২২ টি

১১৮ টি

উপরের তালিকাগুলো হল বাঙালিদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানাভাবে বঞ্চিত হওয়ার গুটিকয়েক নমুনামাত্র।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধ হয়। ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ প্রকাশ্যভাবে এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং মাত্র ১৭ দিন এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল। তবু এই যুদ্ধের ফলে পূর্ব বাংলার জনগণের  চোখ খুলে যায়। তাঁরা দেখেছিলেন, বহিঃশত্রুর আক্রমনের মুখে তাদেরকে রক্ষা করবার মত কোন সুনিশ্চিত ব্যবস্থাই করা হয়েছিল না। এই যুদ্ধে বহির্বিশ্ব থেকে পূর্ব বাংলা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এমনকি, পাকিস্তানের অন্য অংশের সঙ্গে এই অংশের কোন যোগাযোগই ছিল না। জনগণের নিকট এই অঞ্চলের সার্বিক অসহায়ত্বের একটি নগ্নছবি প্রকটভাবে ধরা পড়ে। তাঁরা মর্মে মর্মে অনুভব করে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিমাতাসুলভ মনোভাব দিনে দিনে তাদেরকে গোলামির কঠিন জিঞ্জিরে বেঁধে ফেলছে এবং এক ভয়াবহ ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। একই সাথে পাকিস্তান সরকার এ পূর্ব বাংলার সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানে। এই আঘাত পূর্ব বাংলার জাগ্রত জনতাকে, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী মহলকে বিক্ষুদ্ধ করে।

যুদ্ধের পরিসমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে জনমনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উদাসীনতা ও বৈষম্যমূলক আচরণের অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠতে থাকে। পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন জনগণের নিকট প্রকট হয়ে দেখা দেয়। পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির জন্য কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। ১৯৬৫ সালের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর কার্যকলাপের প্রবাহ নতুন খাতে বইতে শুরু করে। ছয় দফা এই নতুন প্রবাহ পথের প্রথম ফসল- পূর্ব বাংলার মুক্তির সনদ, তথা স্বাধীন বাংলাদেশের পথে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ।

১৯৬৫ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর আইয়ুব খান ঢাকায় এসে বৈঠকে বসেন। আওয়ামী লীগ থেকে বঙ্গবন্ধু, সালাম খান, তাজউদ্দিন আহমেদ, নূরুল ইসলাম চৌধুরী এবং জহিরুদ্দিন প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গ এ বৈঠকে বসেন। বৈঠকে আইয়ুব খান প্রথমে প্রশ্ন করে বসেন- “বলুন আপনারা কেন এসেছেন, কি আপনাদের বক্তব্য?” বঙ্গবন্ধু সোজা দাঁড়িয়ে বলেন, “আমরা তো নিজে থেকে আসিনি- আপনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাই এসেছি- আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, কিন্তু এভাবে আমাদেরকে ডেকে নিয়ে এসে অপমান করার অধিকার আপনার নেই।” এ বৈঠকে বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় কিভাবে অরক্ষিত রাখা হয়েছিল এবং কিভাবে পূর্ব বাংলাকে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এসব কথা তুলে ধরেন। তিনি আভাসে-ইঙ্গিতে তাঁর ছয়- দফার সারমর্মই আইয়ুব খানের সামনে বিচ্ছিন্নভাবে তুলে ধরেন। কোন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এ বৈঠক শেষ হয়না, তবে আইয়ুব খান একথা অবগত হয়ে যান যে, পূর্ব বাংলায় যে সিংহপুরুষের আর্বিভাব ঘটেছে তাঁকে সহজে কাবু করা যাবে না। এতে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে একের পর এক হয়রানিমূলক মামলা দায়ের হতে থাকে।

২৮ শে জানুয়ারি ১৯৬৬ বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রবিরোধী বক্তৃতা দানের অভিযোগে পাকিস্তান দণ্ড বিধির ১২৪ (ক) ধারা মতে এক বৎসর এবং আপত্তিকর বক্তৃতাদানের জন্য জননিরাপত্তা আইনের ৭ (৩) ধারা মতে আর এক বৎসর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে জেলে পাঠানো হয়। উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা হলে বিচারপতি আর.টি.তালুকদার তাঁকে অন্তর্বতীকালীন জামিন মুক্তির আদেশ প্রদান করেন। ফলে সেদিনেই তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তিদানের সময় বঙ্গবন্ধুকে জেলগেটে বিপুল সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। পরদিন অর্থাৎ ২৯ শে জানুয়ারিতেও আবার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তান জননিরাপত্তা আইনের ৭ (৩) ধারামতে অপর একটি অভিযোগ আনা হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে “পূর্ব পাকিস্তান রুখে দাঁড়াও” শীষক প্রচারপত্র মামলার শুনানি হবার তারিখ ছিল, এ মামলাতেও বঙ্গবন্ধুকে অন্যতম আসামী করা হয়। এইভাবে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে একের পর এক অনেকগুলো মামলার জাল বিস্তার করে তাঁকে হয়রানী করা হচ্ছিল। গভর্নর মোনায়েম খান ঘোষণা করেন যে. তিনি যতদিন পূর্ববঙ্গের গভর্নর থাকবেন ততদিন বঙ্গবন্ধুকে জেলে থাকতে হবে।

গভর্নরের দম্ভোক্তি ও হয়রানিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনায় পূর্ব বাংলার রাজনীতি সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র হয়ে ওঠে, অপরদিকে তাসখন্দ চুক্তির ফলে পশ্চিম পাকিস্তানেও অসন্তোষ দেখা যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি দলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে লাহোরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী চেীধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে ৫ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় সম্মেলন আহবান করা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রথমত এই সম্মেলনে যোগদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। অনেক আলোচনার পর স্থির হয় যে, পূর্ব বাংলা থেকে প্রতিনিধি যোগদান করবে। বঙ্গবন্ধু স্থির করলেন যে, তিঁনি নিজেই যাবেন এবং এতকাল পূর্ব বাংলার স্বার্থ নিয়ে যে কথা ভেবেছেন, যে কথাগুলো অগোছালোভাবে বলে এসেছেন, সেগুলো লিখে নিয়ে যাবেন। অতঃপর তিঁনি তাঁর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রের কয়েকজন অনুরাগী নিয়ে আলফা ইনসিওরেন্সের কক্ষে বসে ছয়-দফার একটি সংক্ষিপ্ত খসড়া প্রণয়ন করেন। এভাবেই প্রণীত হলো বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ছয়-দফা।

লেখকঃ এম.পিল ফেলো গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ, পরিকল্পনা বিভাগ, পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত