জুলিও কুরি শেখ মুজিব

2583

Published on মে 23, 2020
  • Details Image

মামুল আল মাহতাবঃ

নিজের জীবদ্দশায় তার কালজয়ী অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড়ো স্বীকৃতি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় আর বাঙালির জাতির পিতার মর্যাদা লাভ। বঙ্গবন্ধুর অর্জনগুলোর যে বিশালত্ব, কোনো পদকের মাপকাঠিতে তা মাপার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। তার পরও একটি পদকের কথা ঘুরেফিরেই চলে আসে। আশির দশকের শেষ ভাগে আর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের করিডরে ‘জুলিও কুরি শেখ মুজিব, লও লও লও সালাম’ স্লোগানে যে কত সহস্রবার গলা ফাটিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্বশান্তি পরিষদ নামের একটি সংগঠন ঢাকায় একটি অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে আজকের এই দিনে বঙ্গবন্ধুর হাতে এই পদকটি তুলে দিয়েছিলেন। সংগঠনটির বাংলাদেশ চ্যাপ্টারটি আজও সক্রিয় এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহযোদ্ধাদের অনেকের এই সংগঠনটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে, এটির সঙ্গে আমারও এক ধরনের পরোক্ষ যোগাযোগ বিদ্যমান। একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযু্দ্ধ এবং তারও আগে জেল-জুলুম আর দমন-পীড়নের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় আর বিশ্বব্যাপী শোষিতের পক্ষে তার উচ্চকিত অবস্থানের যত্সামান্য স্বীকৃতি ছিল বঙ্গবন্ধুর এই ‘জুলিও কুরি পদক’ প্রাপ্তি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সেই নেতা, যিনি ঘোষণা করেছিলেন শোষক আর শোষিতের মধ্যে দ্বিখণ্ডিত এই পৃথিবীতে তার এই অবস্থান শোষিতের পক্ষে। তিনি জীবন দিয়েছেন অকাতরে, সপরিবারে, কিন্তু তার ঘোষিত অবস্থান থেকে সরে আসেননি।

বাংলাদেশে এবার ফসলের বাম্পার ফলন হয়েছে। অকাল কোনো বন্যায় ক্ষতি হয়নি ফসলের একটি দানারও। এমনকি আম্ফানেও নয়। সেই সুযোগই পায়নি আম্ফান। তার আগেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপে বিশাল সব হার্ভেস্টার মেশিন ফসলের মাঠ থেকে কেটে সাবাড় করেছে সব ধান। ধান কাটা হয়েছে রাত ১১টায়, ধান কাটতে পাঠানো হয়েছে বাস বোঝাই শ্রমিক, ধান কেটেছে ছাত্রলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগ—কে নয়? মাঠ থেকে সরাসরি উত্পাদিত পণ্য কিনে নিয়ে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর সদস্যরা পাশাপাশি নিশ্চিত করছেন কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিও। তার ওপর এসেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে লক্ষাধিক কোটি টাকার অভূতপূর্ব প্রণোদনা। তাকে যে শুধু শুধুই ‘মমতাময়ী মা’ বলা হয় না এর স্বাক্ষর আরো একবার রাখলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। মসজিদের ইমাম থেকে মাদ্রাসার শিক্ষক, গার্মেন্টস শ্রমিক থেকে প্রবাসী শ্রমিক কিংবা নিম্ন থেকে মধ্যবিত্ত—কেউ বাদ যায়নি তার এই বিশাল প্রণোদনা থেকে। ১ কোটি ঘরে পৌঁছেছে সরকারের বিশেষ সহায়তার কার্ড আর ৫০ লাখ মোবাইল নম্বরে ঢুকেছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহারের আড়াই হাজার করে টাকা।

২০১৩-তে একবার আর তারপর ২০১৫-তে আবারও এদেশটা পরপর দুই দুই বার লকডাউন-এ গিয়েছিল। তখন সরকার শত চেষ্টায়ও চালু রাখতে পারেনি কলকারখানা, খোলাতে পারেনি শপিংমলও। রাস্তায় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নামানোর দাবি তোলেনি সেদিন কেউই। পুলিশ প্রহরায় মহাসড়কে পণ্যবাহী কনভয় সচল রাখতে সরকারের নাভিশ্বাস উঠেছিল তখন। অথচ তখন বাংলাদেশের বাইরে পৃথিবীতে আর কোথাও কোনো লকডাউন ছিল না। এদেশের বাইরে সেদিন কোথাও আগুনে পুড়ে মরেনি মানুষ আর গরু, কোথাও পেট্রোল বোমায় ভস্ম হয়নি রেলগাড়ি থেকে ঠেলাগাড়ি সবকিছুই। সেদিন তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষাধিক কোটি টাকার প্রণোদনা দিতে হয়নি। তার পরও সেদিন যখন বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হয়নি, তবে আজ কেন কথায় কথায় দুর্ভিক্ষের জুজু? সেদিন যদি ঘুরে দাঁড়ানো বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়ে থাকতে পারে, তবে আজ কেন ‘অর্থনীতি মুখ থুবড়ে ঐ পড়ল বলে’ আমাদের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ থেকে রেডিমেড বের করে আনা রূপকথার গল্প শোনানো? আর যদি প্রণোদনাই নেবেন, তবে কেন শারীরিক দূরত্ব বজায় না রেখেই শ্রমিককে ঘামের মূল্য চাইতে নামতে হচ্ছে রাজপথে?

অর্বাচীন যত যুক্তি আর সীমাহীন যুক্তিহীনতার এই করোনাকালে তাই ‘জুলিও কুরি শেখ মুজিব’-এর শূন্যতা বড়ো বেশি অনুভব করি। বড়ো বেশি ‘চাই-চাই আর খাই-খাই’-এর এই সময়টায় যখন খুব বেশি হতাশায় ডুবতে বসি, তখন আবারও আশায় বুক বাঁধার শক্তি পাই। বঙ্গবন্ধু নেই কিন্তু মাথার ওপর ছায়া হয়ে আছেন তো তারই কন্যা। আমাদের শক্তিটা তো সেখানেই। কাজেই আগামী বছর এই দিনে আবার যখন শোষিতের মুক্তির দিশারি ‘জুলিও কুরি শেখ মুজিবের’ স্মরণে আরো কোনো পত্রিকার জন্য কোভিড-১৯ মুক্ত বাংলাদেশে আরেকটি কলাম লিখতে বসব আমি বিশ্বাস করি সেদিনের সেই বাংলাদেশে ‘চাই-চাই আর খাই-খাই’ এই লোকগুলোর সংখ্যা আজকের চেয়ে কিছুটা হলেও কম হবে।

লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

সৌজন্যেঃ দৈনিক ইত্তেফাক

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত