শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির স্মৃতিচারণ বঙ্গবন্ধুর জানা-অজানা অধ্যায়

3527

Published on মার্চ 17, 2020
  • Details Image

লন্ডনে ফেব্রুয়ারির এক বৃষ্টিস্নাত শীতের সকাল। ইতিহাসের কিছু না জানা কথা জানার ইচ্ছায়। যে ইতিহাসের আদ্যোপান্তে জড়িয়ে আছেন সর্বকালে শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এ ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর পাশে অপর চরিত্রের নাম শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি! যিনি এই ৮৭ বছর বয়সেও পুঁথিপাঠের মতো করে বলে দিতে পারেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ১ যুগের সখ্যতার কথা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তের কথা, তার চাহনি, অঙ্গভঙ্গি, ভরাট গলায় বলা প্রতিটি শব্দের বিবরণ চোখ বন্ধ করে দাঁড়ি-কমাসহ বলে দিতে পারেন তিনি। দৈনিক আমাদের সময়ের কাছে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাটানো কিছু মুহূর্তের কথা জানালেন মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুর সম্মাননা পাওয়া শশাঙ্ক ব্যানার্জি।

৮৭ বছর বয়স্ক শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি এখন অবসর জীবনযাপন করছেন। বাসার দেয়াল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ১০ জানুয়ারি ’৭২ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের পাশাপাশি সিটে বসা ছবিখানি উজ্জ্বল হয়ে ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। সেই সঙ্গে ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে বিদেশি বন্ধুর সম্মাননা নেওয়ার ছবিটিও শশাঙ্ক ব্যানার্জির বসার ঘরে গুরুত্বসহকারে রাখা আছে।

১৯৫৫ সালে ফরেন চাকরিতে যোগ দেওয়া শশাঙ্ক ব্যানার্জি ’৮৫ সালে অবসর নেন। ৬২ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার স্বপ্ন সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্ব পর্যন্ত নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন শশাঙ্ক ব্যানার্জি। শশাঙ্ক ব্যানার্জি বলেন, এমন সুপুরুষ, এমন কণ্ঠ ও এমন সুন্দর ভাষার বক্তৃতা দেওয়া একজন অসীম সাহসী দেশপ্রেমিক মহান নেতার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল বা আমাকে নামে চিনত এ যেন আমার পরম ভাগ্য। আমার জন্ম স্বার্থক।

শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পলিটিক্যাল অফিসার হিসেবে ভারতীয় উপহাইকমিশন হিসেবে বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন। তারপর কেটে যায় প্রায় দুবছর। জাতির জনকের সঙ্গে প্রথম দেখা সম্পর্কে জানতে চাইলে চোখে মুখে এক আনন্দের আভা ফুটে উঠল এস ব্যানার্জির মুখে। তিনি এ মহান নেতার সঙ্গে স্বাক্ষাতের গল্প বললেন এভাবে, ১৯৬২ সালের ২৪ মার্চ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বড়দিনের এক নৈশভোজের এক অনুষ্ঠান ছিল। উৎসব শেষে রাত ১২টায় সহধর্মিণীসহ ঢাকায় আমার চক্রবর্তী ভিলায় ফিরলাম। আমার বাড়ির পাশেই ছিল দৈনিক ইত্তেফাক অফিস। ঘরে প্রবেশ করতে না করতেই সামনের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। দরজা খুলে দেখলাম ১৪ বছরের এক ভদ্র, বিনয়ী অচেনা কিশোর দাঁড়িয়ে। সালাম বিনিময় করে সেই কিশোর ছেলেটি আমাকে বললেন, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া আপনাকে নিয়ে যেতে পাঠিয়েছেন।

দৈনিক ইত্তেফাক ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার লেখার আমি নিয়মিত পড়ি। তাই তাকে ঘিরে ছিল আমার আলাদা মুগ্ধতা। তাই ছেলেটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, ‘যাই ঘটুক না কেন আমি এই মধ্য রাতেই দেখা করতে যাব।’ তাই তিনি ছেলেটিকে বলে দিলেন মানিক মিয়াকে গিয়ে জানাও কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি দেখা করতে আসছি।

শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি বলেন, ‘আমি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে মানিক মিয়া তার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। এই প্রথম আমি তাকে দেখলাম। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে করমর্দন করে অস্বাভাবিক মুহূর্তে দেখা করতে আসায় জন্য ধন্যবাদ জানালেন। তিনি আমাকে নাম ধরে সম্বোধন করলেন এবং পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের দিকে ফিরে তাকিয়ে হাতের ইশারায় পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো ভদ্রলোকরে ছবি আমি পত্রিকায় দেখেছি। তার ভাষণও শুনেছি, তাই চেহারাও খুবই পরিচিত। মানিক মিয়া স্যারকে আমি হেসে বললাম পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই।’

শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি বলেন, আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর এই প্রথম শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আমার দেখা। আমাকে বলতেই হবে, এতটা কাছ থেকে তাকে দেখার পর ও তার কথা শোনার পর আমি পুরোটা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

পরিচয়ের সময় মুজিব শক্ত হাতে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন এবং আমাকে তুমি সম্বোধন করে কথা শুরু করলেন। আমি মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে তাকে বললাম, আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন কিন্তু আমি আপনাকে তুমি বলতে পারব না।

সেদিন শেখ মুজিবের পরনে ছিল লুঙ্গি, পায়ে চপ্পল, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, গায়ে সোয়েটার। শেখ মুজিবকে বললাম, আমি অধমের সঙ্গে আপনি কেন দেখা করতে চাইলেন? কেন ডাকলেন? তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, আমি পূর্ববাংলার স্বাধীনতার কথা চিন্তা করছি। শেখ মুজিবের কথা শুনে আমি শুধু চমকেই যাইনি, রীতিমতো দাঁড়িয়ে গেলাম। অবাক হয়ে বললাম, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা যদি জানে মেরে ফেলবে। এটা তো সাংঘাতিক ব্যাপার। এটা প্রকাশ হবে না তো! প্রকাশ হলে দেশদ্রোহী মামলা হবে। সাবধান, এভাবে ওপেন বলবেন না। আপনাদের প্রাণ তো যাবেই; ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। তবে আপনারা নিশ্চিত থাকুন, আমার তরফ থেকে এটি ফাঁস হবে না। তিনি বললেন, তাদের তরফ থেকেও ফাঁস হবে না। সেদিন এ দুই মহান ব্যক্তির সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হলেও তাদের কর্মকা-ের সঙ্গে আমি পেশাগত দায়িত্ববোধের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানসিকভাবে জড়িয়ে গেলাম।

সেই রাতে ইতিহাসের পাতা উল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিব গোপনীয় চিঠিটি ব্যক্তিগতভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কাছে লিখেছিলেন। যেখানে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম শুরুর কথা লেখা ছিল। চিঠিতে জোর দেওয়া হয়, পশ্চিম পাকিস্তানে পাঞ্জাবি মুসলমানদের সামরিক দমন, নিপীড়ন, বৈষম্য ও শোষণের ওপর। তিনি চিঠিটি শেষ করেছিলেন একটি রোডম্যাপ ও সময়সূচি দিয়ে। শেখ মুজিব ১৯৬৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বা খুব বেশি হলে ১ মার্চ লন্ডন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন।

শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি বলেছেন, ‘স্বাধীনতার পরিকল্পনা নিয়ে লেখা শেখ মুজিবের চিঠি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর অফিসে “‘ট্রিপল কোডেড’’’ সাইফার টেলিগ্রামের মাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল। আসল চিঠিও একই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর মনোযোগ আকর্ষণ করে পাঠানো হয়। তিনি ভালোমতো শেখ মুজিবের চিঠি পড়ে প্রস্তাবটি খতিয়ে দেখলেন এবং দ্রুত তিনি তার নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের নিয়ে একটি মিটিংয়ে বসলেন। শেখ মুজিবের চিঠি নিয়ে নেহেরু তার বাসভবনে সব মুখ্যমন্ত্রী, গভর্নর ও তিন বাহিনীকে নিয়ে বৈঠক করেছিলেন। বৈঠকে শেখ মুজিবের চিঠি দেখিয়ে তার স্বাধীনতার প্রস্তাব ও ভারতের সহযোগিতার বিষয়টি তুলে ধরে সবার মতামত জানতে চাইলেন। শেখ মুজিবকে না বললে অভদ্রতা হবে মনে করে, নেহেরু ছয় মাস সময় নিলেন। অন্যদিকে শেখ মুজিব বিষয়টিকে ঢাকাস্থ ভারতীয় মিশনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা মনে করে আগরতলা ছুটে গিয়েছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা!

শশাঙ্ক ব্যানার্জি বলেন, চীনের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের বেদনা সইতে না পেরে, ’৬৪ সালে নেহেরু পরলোক গমন করলেও তিনি শেখ মুজিবের স্বাধীনতা-সংগ্রামকে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের কথা যাতে অন্যথা না হয়, সেই কথা তার সন্তানকে বলে গিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় এসে তার পিতার অঙ্গীকার রক্ষা করেছিলেন।

ব্যানার্জি বলেন, ১৯৬৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আমাকে তার অফিসে ডেকে নিলেন। বললেন, আমাকে বাগদাদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমার মূল দায়িত্ব হচ্ছে, শেখ মুজিবের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং আমার ওপর অর্পিত আগের দায়িত্ব সেখানে বসে পালন করা। বাগদাদ থেকে ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে তিনি বপ্রন্ধুর সঙ্গে গোপনীয়ভাবে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। ইন্দিরা গান্ধীর বার্তা পৌঁছে দিতেন। সেখান থেকে ’৭০ সাল পর্যন্ত এ কাজ করে তিনি লন্ডনে বদলি হয়ে আসেন। লন্ডনে এসেও তিনি তার কাজ অব্যাহত রাখেন।

শশাঙ্ক শেখ ব্যানার্জি বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী একদিকে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয় অর্জন যেমন দেখতে চেয়েছেন, তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে জীবিতভাবে মুক্ত হয়ে ফিরে আসেন; সে জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছেন। ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে ‘শেখ সাব’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি বলেছিলেন, শেখ সাব ফিরে না এলে স্বাধীন বাংলাদেশ এতিম হবে এবং তার স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে। ভারতে এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল।

ইন্দিরা শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য অস্থির ছিলেন। ভুট্টো ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান এয়ারলাইনসের (পিআই) একটি ফ্লাইটে লন্ডনে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন এবং ভারতীয় দূতাবাসে বার্তা পাঠালেন। সেই শীতের রাতে খবর পেয়ে লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বিপন্তারসহ আমরা তুমুল উত্তেজনা ও আনন্দে রাত ৪টার সময় হিথ্রো বিমানবন্দরে ছুটে গেলাম। ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২ সকাল ৬টায় শেখ মুজিব লন্ডনের বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জের ‘এলিয়ক অ্যান্ড ব্রাউন্ড স্যুইটস’-এ এসে পৌঁছেন। ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের এশিয়ান ডেস্কের প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ড তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। আমাকে দেখেই বঙ্গবন্ধু বলেন উঠলেন, ‘আরে ব্যানার্জি, কেমন আছ?’ আসো আসো বলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললাম, আপনি কী মনে করেছিলেন আমিও জেলে আছি? আমি ভালোই আছি। হাইকমিশনার ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলিয়ে দেন। ৩০ মিনিটের সেই টেলিফোন কথোপকথনে ইন্দিরা মুজিবকে তার জীবনের স্বপ্ন স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম উপলক্ষে অভিনন্দন জানান এবং ঢাকা যাওয়ার পথে নয়াদিল্লি ঘুরে যাওয়ার জন্য আন্তরিক আমন্ত্রণ জানান।

এরই মধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি বৈঠকের ব্যবস্থা ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে করে ফেললেন সাদারল্যান্ড। শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি বললেন, ইন্দিরা গান্ধী এয়ার ইন্ডিয়ায় দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত বাতিল করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে আলাপ করে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে দিল্লি হয়ে তার স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করেছিলেন। কারণ অনেকগুলো সোর্সের যে কোনো একটি ইন্দিরা গান্ধীকে জানিয়েছিল, পাকিস্তানি আইএসআইয়ের কোনো এজেন্ট এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটটিতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। তাই বিমান পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের দায়িত্ব তিনি বঙ্গবন্ধুর ওপরও ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের নেতা সেটি গ্রহণ করেছিলেন। ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের একটি মিলিটারি জেট বিমান বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রস্তুত করা হলো।

শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সব প্রস্তুতি যখন চূড়ান্ত তখন প্রশ্ন এলো বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী কে হবেন? অনেক নাম এলো। কিন্তু আমি ইন্দিরা গান্ধীকে বললাম , মুজিবের সফরসঙ্গী হিসেবে আমার থাকা উচিত। কারণ আমি মুজিবকে চিনতাম, তার স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরু থেকে এবং এই মুক্তির সংগ্রামে ঢাকা ও লন্ডনের সঙ্গে একাত্ম ছিলাম। ইন্দিরা গান্ধী এটিকে বিচক্ষণ প্রস্তাব হিসেবে গ্রহণ করেন এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাকে সফর করার অধিকার প্রদান করেন। এমনকি আকাশপথে বঙ্গবন্ধুকে আমার কী বার্তা দিতে হবে, কোন বিষয়ে পটাতে হবে সে সম্পর্কে একটি গাইডলাইনও দেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে আসা তার সফরসঙ্গী হলেন ড. কামাল হোসেন। আকাশপথে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এই ১৩ ঘণ্টার সফর আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মিশনে পরিণত হয়। ইয়ান সাদারল্যান্ড আমাকে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছায় তার পাশের আসনটি গ্রহণ করতে দেন।

বিমান উড্ডয়নের পূর্বমুহূর্তে সাদারল্যান্ড বিদায় নেওয়ার সময় জানতে চাইলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছবি তুলতে আমার কোনো আপত্তি আছে কিনা? আমি বললাম, নিশ্চয়ই কোনো আপত্তি নেই। তিনি জানালেন, ফ্লাইট চলাকালে পাইলট আমার এবং মুজিবের যুগল ছবি তুলবেন যার কপি দিল্লিতে নামার আগেই দেওয়া হবে। তিনি যাত্রা আনন্দময় হোক বলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ইশারায় খেয়াল রাখতে বলে করমর্দন করে বিদায় নিলেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার সেই ঐতিহাসিক ছবিটি তোলা হলো!

ফ্লাইটে নানা কথার মধ্যে হঠাৎ বঙ্গবন্ধু বললেন, ব্যানার্জি তুমি গান গাইতে জানো? অবাক হয়ে বললাম, আমি তো গানের গ-ও জানি না। তিনি বললেন, আরে তাতে কী! তুমি আমার সঙ্গে ধরো। বলেই তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন, আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। বেশ পেছনে বসা ড. কামাল হোসেনদেরও দাঁড়াতে বললেন এবং তার সঙ্গে গান ধরতে বললেন। তিনি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ খুব দরদ দিয়ে গাইতে থাকলেন আর তখন তার দুই চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকল। একজন মহান নেতার গভীর দেশপ্রেম ও মাতৃভূমির প্রতি পরম ভালোবাসা আমাকে আবার মুগ্ধ করল। গান গেয়ে তিনি যখন বসলেন, তখন আমি আমার কূটনৈতিক প্রথা ভেঙে একজন দেশপ্রেমিক নেতাকে বললাম, ‘বঙ্গবন্ধু, আপনাকে আমি প্রণাম করতে পারি? তিনি কিছু বলার আগেই আমি তার চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করলাম।’ কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, এটি হবে আমার স্বাধীন দেশের জাতীয় সংগীত।

বঙ্গবন্ধু একপর্যায়ে বললেন, ব্যানার্জি তুমি তো জানো; প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা বলেছেন ৬ মাসের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে তার ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবেন বলেছেন? বললাম, জানি। তিনি বললেন, আমি চাই ৬ মাস নয়; তিন মাসের মধ্যেই ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করে নেবেন। আমিও আস্তে আস্তে ইন্দিরা গান্ধী যা যা বলেছিলেন তা শুনাতে থাকি। বঙ্গবন্ধু বললেন, ব্যানার্জি, আমার সিদ্ধান্তই হচ্ছে দেশে ফিরে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করার সিদ্ধান্ত আমি তার কাছে ক্লারিজ হোটেল থেকেই পৌঁছে দিয়েছি।

ভারতে যাত্রা বিরতিতে বঙ্গবন্ধুকে লাল গালিচা সবংর্ধনা দেওয়া হলো। এর ফাকে আমি ইন্দিরা গান্ধীকে বিস্তারিত আলোচনা যখন বললাম, তিনি শুধু শুনলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা শুনে অভিনন্দন জানালেন। ইন্দিরা-মুজিব বৈঠকে মুজিবের ইচ্ছায় ৩১ মার্চের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়; যেদিন ছিল বাংলাদেশের প্রতি ভারতের নিঃশর্ত বন্ধুত্বের প্রমাণ।

পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে, দিল্লির কূটনৈতিক সাফল্যে অজেয় শক্তিতে বঙ্গবন্ধু তার স্বাধীন দেশের জনগণের মাঝে ফিরলেন বীরের অভ্যর্থনা নিয়ে। শশাঙ্ক এস ব্যানার্জি বলেন, তার জীবনে এর আগে কখনো এমন ফুটন্ত গনগনে গণজমায়েত দেখেননি। ১০ লাখেরও বেশি মানুষ জমায়েত হয়ে তাদের প্রিয় নেতাকে ফিরে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে স্লোগানে যেভাবে এক মহান নেতাকে অভ্যর্থনা জানাল, সেই দৃশ্য আমৃত্যু আমার মনে থাকবে।

শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সর্বশেষ দেখা সম্পর্কে বলেন, ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন গল ব্লাডার অপারেশনের জন্য লন্ডন এলেন, তখন আমি বার্লিনে আমার স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছি। এমন সময় লন্ডন থেকে আমাদের হাইকমিশনার জার্মানি নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে বললেন, শেখ মুজিব লন্ডনে এসেছেন এবং ব্যানার্জিকে খুঁজছেন। আমাকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি তাড়াহুড়া করে লন্ডনে ফিরে এলাম। আমার স্ত্রী ও ছেলেদের বাসায় রেখেই হাসপাতালে যখন ছুটে গেলাম তাকে দেখতে, তখন বললাম বঙ্গবন্ধু আপনার কি হয়েছে যে, আপনাকে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে আসতে হলো? তিনি তার শারীরিক অসুস্থতা ও যন্ত্রণার কথা বললেন। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব তখন তার সঙ্গে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে রেণু বলেই ডাকতেন।

বঙ্গবন্ধু সেদিন বললেন, ‘ব্যানার্জি, তোমার স্ত্রীর জন্য রেণু একটা উপহার নিয়ে এসেছে। তুমি একা এলে কেন? কাল তোমার স্ত্রীকে নিয়ে আসবে। আর রেণু বললেন, পরদিন আসার সময় তার পান খাওয়ার জন্য জর্দা নিয়ে আসতে হবে। পরদিন আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে দেখা করতে গেলে তারা আমার স্ত্রীকে অনেক স্নেহ করেন। রেণু হালকা সবুজ রঙের একটি জামদানি শাড়ি আমার স্ত্রীকে উপহার দেন। তাদের এই চমৎকার উপহার পেয়ে আমার স্ত্রী খুব খুশি হন। আমিও অনেক খুঁজে পেয়ে রেণুর জন্য নিয়ে গেলাম পান খাওয়ার জর্দা!

পরে আবার যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একা দেখা করতে যাই, তখন একটি আকর্ষণীয় বিষয় আলোচনা করেন। বঙ্গবন্ধু চাইছিলেন, তার বাঙালি যেমন যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তেমনি পাকিস্তানের বেলুচ, সিন্ধু ও পশতুনরা যে স্বাধীনতা চাইছে সেটিও যুদ্ধ করে অর্জন করবে। এ ক্ষেত্রে তিনি চাইছিলেন তার সঙ্গে ভারত সাহায্যে এগিয়ে আসুক। তিনি বললেন, এই স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাদের সঙ্গে ব্যানার্জি তুমি ভারতীয়দের সঙ্গে একটি বৈঠক করিয়ে দিতে পারবে? আমি বললাম, আপনি আগে আলোচনা করে দেখুন তারা কী চায়? তারপর কথা বলতে পারি। বঙ্গবন্ধু হাসপাতালেই সে সময় লন্ডনে অবস্থানরত পশতুনের জাতীয়তাবাদী নেতা খান আবদুল ওয়ালি, বেলুচ জাতীয়তাবাদী নেতা আকবর খান বুগতি ও সিন্ধের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা জি এম সাইয়েদকে ডেকে পাঠান। তারা প্রায় এক ঘণ্টা হৃদয় উজাড় করে কথা বলেছেন। বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আসলে বাংলাদেশের সঙ্গে পরজয়ের পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত পাকিস্থানকে আরও একটি ধাক্কা দিতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু! আর এই মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে হয়তো আজকে স্বাধীন দেশের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ায় আরও ছোট কয়েকটি দেশ যুক্ত হতো! বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৯৭৩ সালেই আমার শেষ দেখা! এই দীর্ঘ আলোচনার পর শশাঙ্ক ব্যানার্জি একটু থামলেন।

একটু থেমে শশাঙ্ক ব্যানার্জি বললেন, ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো, ইস, কি যে কষ্ট পেয়েছিলাম! এমন একজন হিমালয়ের মতো মানুষকে এরা মেরে ফেলল! এটুকু বলেই তিনি অন্যমনস্ক হলেন!

বুঝতে পারি তিনি চলে গেছেন একটি ঘোরের মধ্যে! এতক্ষণ তন্ময় হয়ে শুনছিলাম এক জীবন্ত কিংবদন্তির কথা! নোট নেওয়া বন্ধ করে শশাঙ্ক ব্যানার্জির মুখের দিকে তাকাই! বুঝতে পারি ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় বুকে ধারণ করে চলা মানুষটি চলে গেছেন একটি ঘোরের মধ্যে! ফেরার সময় হাত মেলাতে গিয়ে আমি শিহরিত হই! আমার হাতে সেই হাত, যে হাতে স্পর্শ পেয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের!

সৌজন্যেঃ দৈনিক আমাদের সময় (১৭ মার্চ ২০২০)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত