বঙ্গবন্ধু: কৈশোরেই চেনা মুখ - ফয়সল আবদুল্লাহ

2557

Published on মার্চ 15, 2020
  • Details Image

ডানপিটে কৈশোর

বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। দুদিন পর গুনে গুনে ১০০ বছর হবে। ১০০ বছর আগের শৈশব আর এখনকার শৈশব তো এক নয়। এখনকার পরিবারগুলো ছোট ছোট। আগে ছিল বিশাল বড় যৌথ পরিবার। বঙ্গবন্ধুও বড় হয়েছেন বড় একটা পরিবারে। বিশাল বড় সেই পরিবারই হলো শেখ পরিবার। শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন ওই পরিবারের বড় ছেলে (নাতি-পুতিদের মধ্যে)। ১০০ বছর আগে হলে কী হবে, বঙ্গবন্ধুর দাদার আমল থেকেই ওই পরিবারে পড়াশোনার চল ছিল। দাদা-নানা, দাদার বড় ভাই, বড় চাচা, বাবা—সবাই ছিলেন শিক্ষিত ও বিচক্ষণ।

চতুর্থ শ্রেণিতেই মাকে ছেড়ে বঙ্গবন্ধু চলে আসেন শহরে। ভর্তি হন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। সঙ্গে থাকতেন বাবা। এমনিতেও বাবার ভক্ত ছিলেন তিনি। বাবার গলা ধরে ঘুমাতেন।

১৯৩৪ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই বেরি বেরি রোগে আক্রান্ত হন। দুর্বল হয়ে পড়ে হূিপণ্ড। চিকিত্সা করতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় কলকাতায়। দীর্ঘ দুই বছর চলল চিকিত্সা। কিন্তু ফিরতে না ফিরতেই ১৯৩৬ সালে ধরা পড়ল চোখের রোগ গ্লুকোমা। আবারও যেতে হলো কলকাতা। ডাক্তার জানালেন, অস্ত্রোপচার করাতে হবে। কিশোর শেখ মুজিব পেয়ে গেলেন ভয়। ঠিক করলেন, অস্ত্রোপচারের কক্ষে যাওয়া যাবে না। যে করেই হোক পালাতে হবে। এদিকে অস্ত্রোপচার না হলে থেকে যায় চিরতরে অন্ধত্বের আশঙ্কা। অবশ্য শেষতক আর পালাতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। সফল অস্ত্রোপচারের পর তাঁর চোখ ভালো হয়ে যায়। চশমা চোখে ফিরে আসেন মাদারীপুরে। কারণ তত দিনে বাবা এখানেই বদলি হয়ে গিয়েছিলেন।

অসুস্থতার জন্য ওই বছর আর স্কুলে ভর্তি হননি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি লিখেছেন, ‘লেখাপড়া নেই, খেলাধুলা নেই, শুধু একটা মাত্র কাজ, বিকেলে সভায় যাওয়া। তখন স্বদেশি আন্দোলনের যুগ। মাদারীপুরের পূর্ণ দাস তখন ইংরেজের আতঙ্ক। স্বদেশি আন্দোলন তখন মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের ঘরে ঘরে।’ বঙ্গবন্ধুর বয়স তখন ১৬। নিয়মিত সভায় যেতেন বলে ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন চেনা মুখ। ইংরেজদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন খুব। জনমানুষের অধিকার নিয়ে লড়ার বীজটা তাঁর বপন হয় ওই সময়গুলোতেই।

১৯৩৭ সালে আবার গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি হন তিনি। সহপাঠীরা তত দিনে বড় ক্লাসে উঠে গেছে। এ সময় বঙ্গবন্ধুর পড়াশোনার জন্য কাজী আবদুল হামিদ নামের একজন শিক্ষক থাকতে শুরু করেন তাঁদের বাড়িতে। ওই শিক্ষক চালু করেন ‘মুসলিম সেবা সমিতি’। সমিতির স্বেচ্ছাসেবকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে এক মুঠ করে চাল সংগ্রহ করবে ও সেটা বিক্রির টাকা দিয়ে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের কিনে দেবে বই-খাতা। বুঝতেই পারছ, ওই স্বেচ্ছাসেবীদের দলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কে। এমনকি অসুস্থ হয়ে যখন ওই শিক্ষক মারা যান, তখন সমিতির দায়ভারও চলে আসে বঙ্গবন্ধুর কাঁধে। দুঃখী মানুষের জন্য ওটাই বঙ্গবন্ধুর প্রথম নেতৃত্ব বলা যায়।

সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা

মুষ্টি চাল সমিতির কারণে কিশোর বয়সেই এলাকার মধ্যমণি হয়ে ওঠেন শেখ মুজিবুর রহমান। সভা-সমিতিতে তাই ডাক পড়ত ঘন ঘন। ১৯৩৮ সালে বঙ্গবন্ধুর বয়স যখন ১৮, তখন বাংলার দুই নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আসবেন গোপালগঞ্জে। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী করার ভার পড়ে স্কুলপড়ুয়া শেখ মুজিবের ওপর। এদিকে আবার দুই নেতার সংবর্ধনা যেন ঠিকঠাক না হয়, এ জন্য রাজনৈতিক চাপও আছে! আছে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ তৈরির একটা পাঁয়তারাও। কিন্তু বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমার কাছে হিন্দু-মুসলমান বলে কোনো জিনিস ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। একসঙ্গে গান-বাজনা, খেলাধুলা, বেড়ানো—সবই চলত।’

এমন বিরূপ ও উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতেই সব সামলে নেন বঙ্গবন্ধু। সোহরাওয়ার্দী মিশন স্কুলে এলে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তাও হয় বঙ্গবন্ধুর। মূলত মূলধারার রাজনীতির লম্বা সিঁড়িতে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম পা পড়ে সেদিনই। কিশোর মুজিবের কথা শুনে মনে মনে উচ্ছ্বসিত হন সোহরাওয়ার্দী। নোটবুক বের করে নাম-ঠিকানা লিখে নেন সেদিন। এরপর চিঠি আদান-প্রদানও হয় দুজনের। কিশোর বঙ্গবন্ধুকে কলকাতায় যেতে বলেন সোহরাওয়ার্দী। রাজনীতির বড় মঞ্চে আরেক পা বাড়ানোর সুযোগ হয় পরের বছরই।

প্রথম জেল

বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটা বড় সময় কাটে জেলখানায়। তবে প্রথমবার জেলে যান নিজের সহপাঠীকে উদ্ধার করতে গিয়ে। তখনো তাঁর কৈশোর কাটেনি। পাড়ায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে একটু উনিশ-বিশ হয়েছিল একদিন। সে ঘটনার সূত্র ধরেই কিশোর মুজিবের বন্ধু মালেককে ধরে নিয়ে গেল পাড়ার এক নেতা।

মুজিবের কাছে খবর এলো, মালেককে নাকি মারধর করা হয়েছে। আর তাঁকে আটকায় কে! দলবল নিয়ে শেখ মুজিব ছুটলেন বন্ধুকে বাঁচাতে। সেখানে গিয়েই ওই নেতাকে সরাসরি বলেন, ‘ওকে ছেড়ে দিতে হবে, না হলে কেড়ে নেব।’ এরপর শুরু হয় মারামারি। খবর পেয়ে শেখ পরিবারের আরো অনেকেই ছুটে আসেন। কিন্তু বিধি বাম। মামলা হয়ে গেল শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যদের নামে। থানায়ও যেতে হলো সবাইকে। পুলিশ ছিল পরিচিত। তারা পরামর্শ দিল কিছুদিন পালিয়ে থাকার। কিন্তু কিশোর মুজিব সেদিন বুক উঁচিয়ে বলেছিলেন, ‘যাব না, আমি পালাব না। লোকে বলবে, আমি ভয় পেয়েছি।’

সেবার কোর্ট হাজতে পরিবারের আরো সাত-আটজনের সঙ্গে আটক ছিলেন বঙ্গবন্ধুও। কিশোর মুজিবকে দেখে কোর্টের দারোগা বলেছিলেন, ‘মুজিবুর খুব ভয়ানক ছেলে।’ এরপর জামিন পাওয়ার আগ পর্যন্ত জেলহাজতে থাকতে হয়েছিল ১০ দিন।

বাবা বনাম ছেলে

মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। অন্যদিকে তাঁর বাবা শেখ লুত্ফর রহমান ছিলেন অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি। স্কুলের সঙ্গে প্রায়ই ফুটবল খেলা হতো অফিসার্স ক্লাবের। বাবা বনাম ছেলের খেলা উপভোগ করত সবাই। ওই সময় অফিসার্স ক্লাব খেলার পেছনে খরচ করত বেশ। বাইরে থেকে খেলোয়াড়ও ভাড়া করে আনত। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই বঙ্গবন্ধুর দলের কাছে হারতে হতো তাদের।

জ্বর নিয়েও পরীক্ষা

১৯৪১ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন শেখ মুজিবুর রহমান। পরীক্ষার আগের দিন হয়ে গেলেন ভীষণ অসুস্থ। মামস হয়ে গলা ফুলে ডোল। সঙ্গে জ্বর ১০৪। গোপালগঞ্জ টাউনের অনেক ডাক্তার এলো। কিন্তু জ্বর কমল না। বাবা নিষেধ করলেন পরীক্ষা দিতে। কিন্তু তরুণ মুজিব নাছোড়বান্দা। পরদিন বাংলা পরীক্ষা দিলেন ঠিকই। এরপর বাকি পরীক্ষাগুলোও বাদ দিলেন না। বাংলায় কিছুটা কম নম্বর পেলেও বাকি সব বিষয়ে ভালো ফলই করেছেন।

 

সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ 

 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত