নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান ও শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলন - মুশতাক হোসেন

2783

Published on নভেম্বর 27, 2019
  • Details Image

শামসুল আলম খান, ডাকনাম মিলন। আমরা এখন যাঁকে একনামে চিনি শহীদ ডা. মিলন হিসেবে। যিনি ১৯৯০ সালে এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানের শেষ দিকের শহীদ। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনকেও (বিএমএ) জনপরিচিতি দিয়েছেন মিলন তাঁর আত্মদানের মধ্য দিয়ে।

সামরিক শাসনবিরোধী গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানে মিলনের জীবন বাজি রেখে লড়াই করার প্রেরণা এসেছে ছাত্ররাজনীতিতে তাঁর সম্পৃক্ততা থেকে। ১৯৭৮ সালে মিলন প্রথম বর্ষে ভর্তি হন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে।

১৯৮০ সালে ছাত্রলীগ (বৈ.স.) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ শাখার বার্ষিক সম্মেলনে নতুন কার্যকরী পরিষদে মিলনকে সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরের বছর ১৯৮১ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদ (ডামেকসু) নির্বাচনে মিলন ছাত্রলীগ (বৈ.স.) প্রার্থী হিসেবে ক্রীড়া সম্পাদক পদে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। এর পরের বছর ডামেকসু নির্বাচনে মিলনকে ছাত্রলীগ (বৈ.স.) পক্ষ থেকে সহসভাপতি পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২৪ মার্চ তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করায় সামরিক শাসনের বাধার কারণে সে নির্বাচন ভণ্ডুল হয়ে যায়। তখন মিলন ছাত্রলীগ (বৈ.স.) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ শাখার সভাপতি ছিলেন।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর মুহূর্ত থেকেই ছাত্রলীগ (বৈ.স.) সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও পাড়ায়-মহল্লায় পুলিশের চোখের আড়ালে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ছাত্রলীগ (বৈ.স.) কর্মীদের সংগঠিত করা হয়। মগবাজার নয়াটোলা শিশুপার্কে সন্ধ্যার পরে মাঝেমধ্যে এ ধরনের বৈঠকে আমি উপস্থিত হয়ে আলোচনা করতাম। সেখানে মিলন উপস্থিত থাকতেন।

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সামরিক শাসক এরশাদের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে এক বিশাল মিছিল স্মারকলিপি প্রদানের জন্য শিক্ষা ভবন অভিমুখে যাত্রা করে। সামরিক শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ছাত্রদের মিছিল শিক্ষাঙ্গন ছেড়ে রাজপথে এলে সামরিক শাসন আর থাকল কই? তাই সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সামরিক জান্তা। বুলেট-বেয়নেটে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকল ছাত্র-ছাত্রী, শিশু একাডেমিতে আসা শিশু-কিশোর আর তাদের অভিভাবকরা। এমনি এক বুলেট-বেয়নেট বিদ্ধ লাশ এলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। লাশ বহনকারী সহপাঠীরা জানাল, তার নাম জয়নাল। বাড়ি নোয়াখালী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এসেছে, উঠেছে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে। ভর্তির ফরম তুলেছে, মধুর ক্যান্টিনে এসে মুনীর ভাইয়ের (ছাত্রলীগ বৈ.স. তৎকালীন সভাপতি) সঙ্গে দেখা করেও গেছে। সে মুনীর ভাইয়ের পার্টি করে। গুলি-বেয়নেটে নিহত জয়নালের লাশ সরিয়ে ফেলার জন্য পুলিশ তৎপর হয়ে উঠল। এমন সময় এগিয়ে এলেন মিলন, তিনি তখন পঞ্চম বর্ষের ছাত্র। মেডিক্যাল কলেজের অন্যান্য ছাত্র, কয়েকজন ডাক্তার-নার্স-কর্মচারীর সহায়তায় জয়নালের লাশ হাসপাতাল থেকে বের করে ছাত্রনেতাদের জিম্মায় দিয়ে দেওয়া হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় সে লাশ আনা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক সেখানে উপস্থিত হন। ঢাকা মহানগরীর হাজার হাজার ছাত্র-জনতা যেন উপচে পড়ল বটতলায়। এলেন রাজনৈতিক নেতারা। তাঁরা হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানালেন, ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করলেন। মিলন যদি জয়নালের লাশ হাসপাতাল থেকে বের করে আনতে না পারতেন, তাহলে বটতলায় এ রকম সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ হতো কি না সন্দেহ!

এ রকম একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল এর সাড়ে সাত বছর পরে, ১৯৯০ সালের ১০ অক্টোবর। সেদিন তিন জোট সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি গ্রহণ করে। একপর্যায়ে পুলিশ তিনটি জোটের সমাবেশে হামলা চালায়। গুলিতে সমাবেশে আসা সিরাজগঞ্জের নাজিরুদ্দিন জেহাদ মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে জেহাদকে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। জেহাদের লাশ পুলিশ লুকিয়ে ফেলতে পারে—এ আশঙ্কায় ছিলেন জেহাদের সঙ্গে হাসপাতালে আসা ছাত্রনেতারা। আবারও এগিয়ে এলেন ডা. মিলন। যেভাবে সাড়ে সাত বছর আগে জয়নালের লাশ হাসপাতাল থেকে বের করে আনা হয়েছিল, ঠিক একইভাবে জেহাদের লাশও পৌঁছে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায়। মিলন ছিলেন এ অপারেশনের কারিগর। জেহাদের লাশ সামনে রেখেই ডাকসুসহ ২২টি ছাত্রসংগঠনের নেতারা শপথ গ্রহণ করেন—এরশাদের পতন না হওয়া অবধি তাঁরা ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করে যাবেন।

এভাবেই সামরিক শাসনবিরোধী দীর্ঘ গণ-আন্দোলনের শুরুতে ও শেষ পর্বে ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানে দুটি ইতিহাস নির্ধারকের ভূমিকা পালন করেন শহীদ ডা. মিলন। আর এর আগে-পরে আন্দোলনের বাঁকে বাঁকে অনেকবার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি। আর সবশেষে মিলন নিজের জীবন দিয়ে এরশাদের সামরিক শাসনের ইতি টেনে দেন।

চাকরিতে যোগদানের পর মিলনকে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলায় পদায়ন করা হলো। রৌমারী হচ্ছে যমুনা নদীর চরে একটি উপজেলা। মিলন খুব উপভোগ করতেন যমুনার বিশাল প্রান্তর পাড়ি দিয়ে রৌমারী যেতে। ওখানে থাকতেই মিলন প্রাণরসায়ন বিষয়ে এমফিল করার জন্য তৎকালীন আইপিজিএমআর-এ ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাঁকে প্রেষণও দেওয়া হয় সরকারি বিধি অনুযায়ী। কিন্তু বিএমএর একজন সংগঠক হিসেবে চিকিৎসকদের আন্দোলন ও প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক (প্রকৃচি) আন্দোলনে সক্রিয় থাকার ‘অপরাধে’ এরশাদের সামরিক সরকার তাঁর ডেপুটেশন বাতিল করে। মিলন পরের বছর আবার ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এমফিল ডিগ্রি লাভের উদ্যোগ নেন। এরই মধ্যে ১৯৮৬ সালে মিলন বিএমএ কার্যকরী পরিষদের প্রকাশনা সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে অবশেষে মিলন প্রাণরসায়নে এমফিল ডিগ্রি লাভ করেন তৎকালীন আইপিজিএমআর থেকে। সে বছরই বিএমএ কার্যকরী পরিষদ নির্বাচনে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন মিলন। ১৯৮৯ সালে মিলন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ফিজিওলজি বিভাগে প্রাণরসায়ন বিষয়ে প্রভাষক পদে যোগদান করেন।

১৯৯০ সালের প্রথম দিকে এরশাদের সামরিক সরকার চিকিৎসকদের, বিশেষ করে মেডিক্যাল শিক্ষকদের শায়েস্তা করার বাসনা থেকে চিকিৎসকদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ একটা স্বাস্থ্যনীতি ঘোষণা করে। ডাক্তারদের বিরুদ্ধে নানা মুখরোচক কথা রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে (তখন বেসরকারি টেলিভিশন ছিল না) প্রচার করে। যে স্বাস্থ্যনীতি এরশাদ সরকার দিয়েছিল তা ছিল স্বাস্থ্য খাতকে এনজিও এবং বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল করে ফেলা। সব নাগরিকের সেবা দেওয়ার সাংবিধানিক দায়িত্ব থেকে সরে এসে স্বাস্থ্যসেবার বাণিজ্যিকীকরণের সেটা ছিল প্রথম উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা। কিন্তু কথামালার সুন্দর মোড়কে তা চট করে ধরতে পারা কঠিন ছিল বৈকি! মিলন তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ছাত্ররাজনীতিলব্ধ জ্ঞান থেকে স্বাস্থ্যনীতির আবরণ সরিয়ে ভেতরের চেহারাটি খুলে ধরেন দেশবাসীর সামনে। ফলে এরশাদের স্বাস্থ্যনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে জনগণের সমর্থন পেতে কোনো সমস্যা হয়নি। ডাক্তারদের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব সৃষ্টির জন্য এরশাদ ও তাঁর দোসরদের প্রচেষ্টা এভাবে ব্যর্থ করে দেন মিলন। বরং এরশাদের গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি জনগণ ও চিকিৎসকদের আরো একাত্ম করে। তাই তখন থেকেই এরশাদ ও তাঁর গুপ্তঘাতক বাহিনী ফন্দি আঁটতে থাকে মিলনকে আঘাত করার জন্য। চিকিৎসকদের আন্দোলন ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য এরশাদের হুমকি ও হয়রানির পাশাপাশি নানা রকম প্রলোভনের ফাঁদও পাতা হয়েছিল। কোনো কিছুই মিলনকে বিরত রাখতে পারেনি। জীবন দিয়ে মিলন তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে গেছেন।

লেখক : ডাকসুর সাবেক জিএস

শহীদ ডা. মিলন সংসদের সভাপতি

 

সৌজন্যেঃ কালের কণ্ঠ 

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত