অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের রূপকার বঙ্গবন্ধু

5826

Published on আগস্ট 28, 2019
  • Details Image

ড. আতিউর রহমানঃ

এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্তের জন্য বঙ্গবন্ধু ছিলেন অন্তঃপ্রাণ। তাই শোকের এ মাসে তারা ভাবেন, এ দেশটি আরও কত আগেই না অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের স্বাদ পেত, যদি বঙ্গবন্ধুকে হঠাৎ এমন করে চলে যেতে না হতো। যদিও তার সুকন্যা পরবর্তী পর্বে এসে গরিব-দুঃখীর দুঃখ মোচনের নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন, তবুও মাঝখানে অনেক বছর হারিয়ে গেছে জাতির জীবন থেকে। এখনো রয়ে গেছে অনেক চ্যালেঞ্জ। সব আবর্জনা দূর করে সমৃদ্ধির পথে স্বদেশকে এগিয়ে নেয়া মোটেও সহজ নয়। আর দ্রুত বেড়ে ওঠা অতি ধনীদের কারসাজি এড়িয়ে সাধারণের কল্যাণে নিবেদিত থাকাও বেশ কষ্টসাধ্য। এমনই এক বাস্তবতায় আমরা স্মরণ করছি বঙ্গবন্ধুর জনকল্যাণের অর্থনৈতিক নীতিকৌশলকে।

বঙ্গবন্ধুর প্রধান রাজনৈতিক লক্ষ্যই ছিল এ দেশের গরিব-দুঃখী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করা। এ কারণে আমরা দেখতে পাই, ওই ছোট্টবেলা থেকেই এবং পরে তার সব রাজনৈতিক কর্মকা-ের মধ্যমণি ছিল এ দেশের সাধারণ মানুষ। তাই তিনি তার ডায়েরির পাতায় লিখতে পেরেছেন, As a man, what concerns mankind concerns me. As a Banglalee, I am deeply involved in all that concerns Bangalees. This abiding involvement is born of and nourished by love, enduring love, which gives meaning to my politics and to my very being. (ডায়েরি, ৩০ মে ১৯৭৩; সূত্র : শাহরিয়ার ইকবাল সম্পাদিত, ‘বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ বছরের দৈনন্দিন কর্মতালিকা ও কতিপয় দলিল’, উত্তরবঙ্গ প্রকাশনী, ২০০০, পৃষ্ঠা ১০৫)। এই মানবিক বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছেন। আর পাশাপাশি বেড়ে উঠেছে ‘কনসেপ্ট বাংলাদেশ’।

১৯৩৬ সাল। বয়স তার মাত্র ১৬ বছর। নেতাজি সুভাষ বসুর স্বদেশি আন্দোলনের একজন কর্মী হতে সচেষ্ট। ওই সময়ই শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার দেখা হয়। তার সাংগঠনিক দক্ষতা দেখে সোহরাওয়ার্দী হন মুগ্ধ। ১৯৩৭ সালে বাবার কর্মস্থল গোপালগঞ্জে মিশন স্কুলে ভর্তি হন। ওই বয়সেই তার শিক্ষক কাজী আবদুল হামিদের নেতৃত্বে গড়ে তোলেন ‘মুসলিম সেবা সমিতি’। উদ্দেশ্য, গরিব ছাত্রদের সেবা করা। এ জন্য আশপাশের বাড়ি থেকে মুষ্টি-ভিক্ষার চাল ওঠাতেন। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় ছাত্র বঙ্গবন্ধু ছিলেন কলকাতায়। লাখো মানুষ মারা যায়। সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে তিনি দুর্ভিক্ষকবলিত মানুষকে বাঁচানোর জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। তার নিজের ভাষায়, ‘আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলো লঙ্গরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। ... দিনভর কাজ করতাম আর রাতে কোনোদিন বেকার হোস্টেলে ফিরে আসতাম, কোনোদিন লীগ অফিসের টেবিলে শুয়ে থাকতাম।’ দাঙ্গাপীড়িত মানুষকে বাঁচানোর জন্য তিনি স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে সুদূর আসানসোল গিয়ে ত্রাণশিবির খুলেছিলেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হলো। তিনি পূর্ব বাংলায় ফিরে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গড়লেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। শুরু করলেন ছাত্র রাজনীতি আর অংশগ্রহণ করলেন ভাষা আন্দেলনে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ হলেন প্রথম রাজবন্দি। পূর্ব পাকিস্তান সরকার তার এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পছন্দ করত না। সর্বক্ষণ গোয়েন্দা লাগিয়ে রাখত। সেই গোয়েন্দারা যেসব প্রতিবেদন সরকারকে পাঠিয়েছেন, সেগুলো থেকে বোঝা যায়, তিনি গণমানুষের স্বার্থকে কতটা গুরুত্ব দিতেন।

বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন ছাড়াও সাধারণ মানুষের জীবনমান সমস্যা ও খাদ্য সংকট নিয়ে তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন। যেমন, পাকিস্তান সরকার কর্ডন প্রথার মাধ্যমে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় খাদ্য যাওয়া নিষিদ্ধ করেছিল। তখন যারা অন্য জেলায় গিয়ে ধান কেটে মজুরি হিসেবে কিছু ধান নিয়ে বাড়ি ফিরতেন, ওই ‘দাওয়াল’রা (ধান কাটা শ্রমিক) বিপদে পড়েন। তাদের স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আগেই বলেছি, পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর এ ধরনের প্রতিবাদের নানা বিবরণ খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, ১৯৪৮ সালের ৪ এপ্রিল ফরিদপুরের এসএন একাডেমিতে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি তুলে ধরেছিলেন বস্ত্র, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংকটের কথা। অনুরূপভাবে ১৯৪৮ সালের ১ জুন অনুষ্ঠিত নরসিংদীর ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির দাবি করেন। একই সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যধতামূলক করার দাবিও জানান। ১৯৪৭ সালের ১৩ জুলাই অন্য আরেকটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে একটি লিফলেটের উদ্ধৃতি দিয়ে শেখ মুজিবকে ‘অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলন’-এর পুরোধা বলে বর্ণনা করা হয়।

শেখ মুজিব ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মূলত সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থনে জিতে মন্ত্রী হিসেবেও পূর্ব বাংলার কৃষক, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের জন্য নানা উদ্যোগ নিতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট সরকার পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের মুখে বেশিদিন টেকেনি। ওই সরকার পতনের পর একমাত্র মন্ত্রী শেখ মুজিবকেই জেলে যেতে হয়েছিল। এরপর ফের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তিনি অনেক নীতি-উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যেমন, প্রাদেশিক সরকারের হাতে আমদানি লাইসেন্স ইস্যু করার ক্ষমতা হস্তান্তর, প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক পাট, তুলা ও তৈরি পোশাকের মতো শিল্পগুলোর নিয়ন্ত্রণ, পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) আমদানি-রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের একটি কার্যালয় এবং সাপ্লাই অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টের মহাপরিচালকের একটি কার্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ ও অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার অন্তত ৫০ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি তোলেন।

ওই সময় পাকিস্তানের দুই অংশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্রটি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান, দেড় হাজার মাইল ভৌগোলিক দূরত্বে অবস্থিত দুই অঞ্চলের জন্য ‘দুই অর্থনীতি’ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। পূর্ব বাংলার অর্থনীতিবিদরা তার এই বৈষম্যের অর্থনীতি ধারণাটিকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বিপুলভাবে সমর্থন করেছিলেন। ওই ধারণার আলোকেই বৈষম্যের মাত্রা বোঝার জন্য বঙ্গবন্ধু কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অর্থনৈতিক কমিশন স্থাপনের দাবি জানান। একটি অর্থনৈতিক কমিশন গঠনও হয়েছিল। ওই কমিশনে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে বাঙালি অর্থনীতিবিদরা কাজ করেন এবং বঙ্গবন্ধু যে বৈষম্যের কথা এতদিন বলে আসছিলেন, এরই প্রতিধ্বনি করেন। কিন্তু ওই কমিশনের প্রতিবেদন দ্রুতই হিমাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু ওই অর্থনীতিবিদ ও সরকারি কয়েক কর্মকর্তার সহায়তা নিয়ে তৈরি করলেন ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা’। দুই অঞ্চলে নিজ নিজ উদ্যোগে শিল্পায়ন, মুদ্রানীতি, বৈদেশিক মুদ্রানীতি, সুদের হার নীতিসহ এমন কিছু দাবি এই ছয় দফায় য্ক্তু করেছিলেন তিনি। তা কার্যত পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা দাবির পর্যায়েই পড়ে। খুব স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানি অভিজনরা তার এই আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করে এবং জেলে আটকে রাখে। গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা ঊনসত্তরের ফেব্রুয়ারিতে তাকে মুক্ত করে। একই সঙ্গে প্রতিবাদী ছাত্র-জনতা তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করে। এর পর ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও তিনি পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রে সরকার গঠন করতে পারেননি। তাই বাধ্য হয়েই অসহযোগের ডাক দেন। আর ৭ মার্চ ডাক দেন মুক্তির। ২৫ মার্চ শুরু হয় নির্মম গণহত্যা। ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। আর সঙ্গে সঙ্গে তাকে করা হয় বন্দি। ইতোমধ্যে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। তাকে আটক করে পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তার নেতৃত্বেই চলে মুক্তিযুদ্ধ। লাখো প্রাণের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়। তবে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ওই বিজয় অপূর্ণই থেকে যায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মহীয়সী নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রাণান্ত প্রচেষ্টা ও বিশ্ব জনমতের চাপে পাকিস্তানি জালেমদের তৈরি ফাঁসির মঞ্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ফিরে আসেন আমাদের জাতির পিতা।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রথমেই তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন; সংবিধান প্রণয়ন; এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন; যুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন; সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী, পুলিশ, বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) পুনর্গঠন; যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন; শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ; শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত বিনামূল্যে ও মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত নামমাত্র মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ; মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন; নতুন ১১ হাজার প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ মোট ৪০ হাজার প্রাথমিক স্কুল সরকারিকরণ; দুস্থ মহিলাদের কল্যাণে নারী পুনর্বাসন ব্যবস্থা; মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেন। এ ছাড়া পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক-বীমা ও ৫৮০টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ এবং এসব চালুর মাধ্যমে হাজারো শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান, সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ও অন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপনসহ একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেন তিনি। একই সঙ্গে প্রণয়ন করেন দক্ষ পররাষ্ট্রনীতি। ওই নীতির মূল কথাই ছিল উত্তর-দক্ষিণ শীতল রাজনৈতিক মেরুকরণের বাইরে রেখে দেশকে ‘জোট নিরপেক্ষ’ রাখা। উদ্দেশ্য, ‘সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরিতা নয়’।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ জরুরি ভিত্তিতে বিনামূল্যে ও কয়েকটি ক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্যে এবং অধিক কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য ধানবীজ, পাটবীজ ও গমবীজ সরবরাহ করা। দখলদার পাকিস্তানি শাসনকালে রুজু করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের মুক্তি দেওয়া হয় ও তাদের সব বকেয়া ঋণ সুদসহ মাফ করে দেওয়া হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরতরে রহিত করা হয়। ধান, পাট, তামাক ও আখসহ গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যপ্রাপ্তির লক্ষ্যে ন্যূনতম ন্যায্যমূল্য বেঁধে দেওয়া হয়। গরিব কৃষকদের বাঁচানোর স্বার্থে সুবিধাজনক নিম্নমুল্যের রেশন সুবিধা তাদের আয়ত্তে নিয়ে আসা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সামাজিক ন্যায়বিচার ও দারিদ্র্য নিবারণের তাগিদে কৃষি উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের পর্যায়ে আনা হয়। ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টনের ফর্মুলা নির্ধারণেও অত্যন্ত জোরদার উদ্যোগ নেন তিনি। যৌথ নদী কমিশন তারই প্রচেষ্টার ফসল। ফলে ভাটির দেশ হিসেবে গঙ্গার পানির ৪৪ হাজার কিউসেক হিস্যা পাওয়ার সম্মতি তিনি আদায় করেন।

শুরুতে রাষ্ট্রীয় খাতকে প্রাধান্য দিয়ে শিল্পায়নের ভিত্তি সুদৃঢ় করলেও ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধু ব্যক্তি খাত বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির দিকে মনোযোগী হন। তাই ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ড. এআর মল্লিক উল্লেখ করেন, ‘পুঁজি বিনিয়োগে বেসরকারি উদ্যোক্তাদিগকে যথাযথ ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করিবার জন্য এবং বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিকল্পে চলতি অর্থ বৎসরের শুরুতে বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা ২৫ লক্ষ হইতে ৩ কোটি টাকায় উন্নীতকরণ এবং বেসরকারি খাতে কয়েকটি নতুন শিল্প গড়িয়া তোলার অনুমতি দেওয়া হইয়াছে’ (বাজেট বক্তৃতা, ১৯৭৫-৭৬, পৃষ্ঠা ৫)। তা ছাড়া ৮২টি পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিমালিকানায় ও আরও ৫১টি কর্মচারী সমবায়ের কাছে বিক্রি করা হয়। এভাবেই তার জীবদ্দশাতেই শিল্পায়নকে ‘ডিরেগুলেট’ করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘প্র্যাগমেটিস্ট’ বঙ্গবন্ধু সুচিন্তিতভাবে স্বদেশকে দ্রুত উন্নয়নের অভিমুখী করতে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধানত, ব্যক্তি খাতনির্ভর হলেও তাকে সহায়তার জন্য জ্বালানিসহ মেগা অবকাঠামো খাত সরকারি বিনিয়োগেই গড়ে উঠেছে। সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ ঘিরেই দেশে উল্লেখ করার মতো প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকন্যার বাস্তবানুকূল এই অর্থনৈতিক নীতিকৌশলের উৎসভূমি যে বঙ্গবন্ধুর গণমুখী উন্নয়ন অভিযাত্রা, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

সর্বশেষ অর্থবছরে আমরা ৮.১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। চলতি অর্থবছরে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ৮.২০ শতাংশ। শুধু প্রবৃদ্ধি নয়, এ দেশের বঞ্চিতজনদের জন্য ব্যাপক অঙ্কের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। অতিদারিদ্র্যের হার আগামী কয়েক বছরেই কমিয়ে ৫ শতাংশের আশপাশে আনার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সবার জন্য পেনশন কর্মসূচি চালু করার পরিকল্পনাও তার রয়েছে। ডিজিটাল ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায় সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে স্বস্তি। প্রশাসনিক ও সামাজিক সেবা হচ্ছে স্বচ্ছ ও দ্রুত। জবাবদিহির ক্ষেত্র হচ্ছে প্রসারিত। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সবচেয়ে গতিময়। তবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলো অর্জনে চাই সার্বিক শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। বিদ্যমান রাজনৈতিক ও সামাজিক শান্তি বজায় রাখা গেলে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জয়যাত্রা নিশ্চয় অব্যাহত রাখা যাবে। আর তা হলেই বঙ্গবন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে।

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

সৌজন্যেঃ দৈনিক আমাদের সময়

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত