মুজিবনগর দিবসের স্মৃতিকথা

3711

Published on এপ্রিল 17, 2019
  • Details Image

তোফায়েল আহমেদঃ

মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের স্মৃতিকথা লিখতে বসে আজ কত কথা আমার মানসপটে ভেসে উঠছে। ৭১-এর ২৫ মার্চ দিনটির কথা বিশেষভাবে মনে পড়ে। এদিন মণি ভাই এবং আমি জাতির জনকের কাছ থেকে বিদায় নেই। বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে টেনে আদর করে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের যে নির্দেশ দিয়েছি, সেই নির্দেশিত পথে তোমরা এগিয়ে যেয়ো। আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। আমার কথা ভেবো না।’

অসাধারণ দৃঢ়চেতা মহান নেতা ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৫ মার্চ রাতে মতিঝিলের আরামবাগে মণি ভাইয়ের বাসভবনে আমরা অবস্থান করি। রাত ১২টায় অর্থাত্ জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে গণহত্যা শুরু করে। এক রাতেই পাকবাহিনী লক্ষাধিক লোককে হত্যা করে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ২৬ তারিখ থেকে কারফিউ জারি হয়। ২৭ তারিখ ২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে আমরা কেরানীগঞ্জ চলে যাই। কেরানীগঞ্জ পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওতে শুনতে পেলাম চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নানের ভাষণ। বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ উল্লেখ করে তিনি বলছেন, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ প্রদান করে বলেছেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উত্খাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে’।”

কেরানীগঞ্জে আমাদের সাবেক সংসদ সদস্য বোরহানউদ্দিন গগনের বাড়িতে আমরা আশ্রয় গ্রহণ করি। জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী সাহেব এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান সাহেব, মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমিসহ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হলো—মণি ভাই ও আমি, মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামান সাহেবকে নিয়ে ভারতের দিকে যাব। বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য আগেই বাসস্থান নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। নির্বাচনের পরপরই বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন, ওরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এবং তিনিও চান নাই ক্ষমতা হস্তান্তর করুক। সেজন্যই ৭১-এর ৩ জানুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) ১০ লক্ষাধিক সংগ্রামী মানুষের মহাসমাবেশে নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ করিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন ৬ দফা প্রশ্নে তিনি কোনো আপস করবেন না। ৭১-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির জনক জাতীয় চার নেতার সামনে আমাদের এই ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন, ‘সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’ বলেছিলেন, ‘এখানে থাকবে। তোমাদের জন্য সব ব্যবস্থা আমরা করে রেখেছি।’ ২৯ মার্চ কেরানীগঞ্জ থেকে দোহার-নবাবগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, সারিয়াকান্দি বগুড়া হয়ে এপ্রিলের ৪ তারিখ আমরা ভারতের মাটি স্পর্শ করি এবং সানি ভিলায় আশ্রয় নেই। এখানে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।

তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেছি। একটি বিশেষ প্লেনে তাজউদ্দীন ভাই, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মণি ভাই এবং আমি যখন শিলিগুঁড়ি পৌঁছাই, তখন পূর্বাহ্নে ধারণকৃত তাজউদ্দীন ভাইয়ের বেতার ভাষণ শুনলাম। এপ্রিলের ১০ তারিখ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নব-নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলাকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করে রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং জারি করা হয় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ তথা ‘Proclamation of Independence’। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন করা হয়; ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’—এই সাংবিধানিক দলিলটির মহত্তর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমরা ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ সদস্যগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম, ‘আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে মার্চ হইতে কার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’ জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুসারে বলতে হয়, ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সনদ। এই সনদ মোতাবেক স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে। বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের আগে ১৬ এপ্রিল গভীর রাতে—মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমি— মুজিব বাহিনীর চার প্রধান, নবগঠিত সরকারের সফরসঙ্গী হিসেবে কলকাতা থেকে একটা গাড়িতে করে রাত ৩টায় রওয়ানা করি সীমান্ত সন্নিহিত মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলা তথা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মুজিবনগরের উদ্দেশে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশ করি প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তাঞ্চল মেহেরপুরের আম্রকাননে। কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল। দিনটি ছিল শনিবার। পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিকসহ আরো অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সকাল ১১টা ১০ মিনিটে পশ্চিম দিক থেকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দৃপ্ত পদক্ষেপে মঞ্চের দিকে এলেন। দেশ স্বাধীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সমবেত সংগ্রামী জনতা গগনবিদারী স্বরে ‘জয়বাংলা’ জয়ধ্বনি দিলো। মুজিবনগরে শপথ অনুষ্ঠান স্থলে একটি ছোট্ট মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথমে মঞ্চে আরোহণ করেন। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদের (এসপি মাহবুব, বীর বিক্রম) নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র দল রাষ্ট্রপ্রধানকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেন। এরপর মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী। সরকারের মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি আবদুল মান্নান, এমসিএ’র (Member of Constituent Assembly) উপস্থাপনায় শপথ অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। প্রথমেই নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক সনদ ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা মায়ের চারজন বীরসন্তান প্রাণ ঢেলে গাইলেন জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। উপস্থিত সকলেই তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলালাম। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম।

মুজিব বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক হিসেবে ভারত সরকারের সঙ্গে সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করতাম আমি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা শ্রী দুর্গাপ্রসাদ ধর (যিনি ‘ডিপি ধর’ নামে পরিচিত) মাঝে মাঝে কলকাতাস্থ হোটেল ‘হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনাল’-এ আমাদের মুজিব বাহিনীর চার প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করতেন। মিস্টার ব্যানার্জী (যার ছদ্মনাম ছিল মিস্টার নাথ) নামে ভারত সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করে সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। এই সাহায্য আমি মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দিতাম। দেরাদুনে আমাদের ট্রেনিং হতো। সেখান থেকে মুজিব বাহিনীর সদস্যবৃন্দ দমদম বিমান বন্দরে নামার পরে ব্যারাকপুরে নিয়ে যেতাম।

মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দুঃসময়ে ভারত আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। মিত্রবাহিনী গঠন করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় সৈনিকরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণোত্সর্গ করেছে। দেশ স্বাধীনের পর জাতির জনকের অনুরোধে স্বল্প সময়ের মধ্যে অর্থাত্ ৭২-এর ১২ মার্চ তাদের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। অথচ ভারতের সুমহান আত্মত্যাগকে তাচ্ছিল্য করে আজো যারা ‘দেশ বিক্রির’ কথা বলে—বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সঠিকভাবেই তাদের চিহ্নিত করেন ‘অর্বাচীন’ হিসেবে।

অনেকেই অনেক কথা বলে যে, মুজিব বাহিনীর সঙ্গে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের ভুল বোঝাবুঝি ছিল। কথাটি মোটেই সত্য নয়। সরকারের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর সমন্বয়কের দায়িত্ব পালনে আমি নিয়মিত ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে সরকারের দপ্তরে যেতাম। জাতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দেখা করে মুজিব বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে সবকিছু তাদের অবহিত করতাম। আমরা যে মুজিব বাহিনী গঠন করেছিলাম তার প্রকৃত নাম ছিল ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ সংক্ষেপে বিএলএফ। সেটাকেই আমরা বঙ্গবন্ধু মুজিবের নামে ‘মুজিব বাহিনী’ নামকরণ করেছি। শুধু মুজিব বাহিনী না, স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা ‘মুজিবনগর’ নামে ইতিহাস হয়ে আছে। সবকিছুই চলেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে, তাকে সামনে নিয়ে।

পৃথিবীতে অনেক নেতা এসেছেন, অনেক নেতা আসবেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো এরকম বিচক্ষণ, সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো নেতা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে আমার জানা নেই। ২০২০-এর ১৭ মার্চ আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে চলেছি—যা হবে মুজিববর্ষ। আশা করি, ‘মুজিববর্ষ’ পালনের মধ্য দিয়ে দেশে-বিদেশে বঙ্গবন্ধুর জীবনী পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হবো।

২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল ৪৮তম মুজিবনগর দিবসে আমাদের প্রত্যাশা, যে লক্ষ্য ও স্বপ্ন নিয়ে জাতির জনক বাংলাদেশকে স্বাধীন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করে গেছেন—সেই পথ ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার মাধ্যমে দেশের মানুষের সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত হবে।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

প্রকাশঃ দৈনিক জনকণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত