১৯৭১, খুলনার আজগড়া গণহত্যা

3022

Published on মার্চ 3, 2019
  • Details Image

আরিফ রহমানঃ

অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করে। বাঙালীর স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে নির্মূল করতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা এ কার্যক্রম চালায়। দীর্ঘ নয় মাস বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের সহায়তাকারী দালালরা ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করে। ৬ লাখ নারীকে ধর্ষণ করে। উর্দুভাষী বিহারীরাও জাতিগত সহিংসতায় সক্রিয় ভূমিকা নেয়। নয় মাস ধরে চলে এই নির্বিকার হত্যাকান্ড।

১৯৭১ সালে বাঙালীর ওপর গণহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে সামনে নিয়ে আসার জন্য কাজ করে যাচ্ছে খুলনার ‘গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র্র’। এই গবেষণা কেন্দ্র থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে গণহত্যা নির্ঘণ্ট। এই গণহত্যা নির্ঘণ্ট হচ্ছে- একাত্তরের প্রতিটি গণহত্যা নিয়ে আলাদা আলাদা এক-একটি গ্রন্থ’।

গণহত্যার স্মৃতিকে ধরে রাখতে দৈনিক জনকণ্ঠ মার্চ মাসে প্রতিদিন ‘গণহত্যা সংঘটিত এলাকা’ নিয়ে একটি করে লেখা প্রকাশ করছে। আজ প্রকাশিত হলো প্রথম কিস্তি খুলনার আজগড়া গণহত্যার কাহিনী।

বি. স

==============

এপ্রিলের ১৭, ১৯৭১। বেলা বারোটার দিকে গ্রামের দক্ষিণ দিক থেকে ছিদ্দিক মোড়ল সংবাদ দিলেন পাকিস্তানী বাহিনী গানবোটে করে পালেরহাটে নেমে আজগড়া গ্রামে প্রবেশ করছে। সঙ্গে আছে স্থানীয় রাজাকার জুম্মান খান। পাকিস্তানী বাহিনী প্রথমে আজগড়ার রথখোলা মন্দিরে উপস্থিত হয়। মন্দিরের প্রতীমা ভাঙচুর করে তছনছ করে ফেলে। এরপরে মন্দিরে রক্ষিত রথসহ পুরো মন্দিরটি আগুনে জ্বালিয়ে দেয়। মন্দিরের পাশে দাঁড়ানো ছিল ৬০ বছর বয়সী পল্লী চিকিৎসক কালীদাস চক্রবর্তী। তিনি অনেকটা বধির ছিলেন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে তিনি নীরব থাকেন। তখন পাকিস্তানী বাহিনী এই বৃদ্ধ লোকটিকে গুলি করে। সেখানেই মারা যান কালীদাস চক্রবর্তী।

এ খবর গ্রামে পৌঁছালে এগিয়ে আসেন ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষাল। প্রায় ৭০ বছর বয়সী এই মানুষটি ছিলেন একজন শিক্ষক। উর্দু ভাষা স¤পর্কে তাঁর ধারণা ছিল। তিনি এগিয়ে গেলেন তাদের বুঝাতে যে, এখানে কেউ আওয়ামী লীগ করে না। বাড়ির বাকি সদস্যদের তিনি বাড়িতে থাকতে বলেন। তাঁর কোন কিছু বলার আগে তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে পাকিস্তানী বাহিনী। এ ঘটনার পরে বিপদ বুঝতে আর কারও বাকি থাকল না। বাড়ির নারী পুরুষ শিশু সবাই বাড়ি ছেড়ে গ্রামের পশ্চিম দিকে ছুটতে থাকে। এরপর পাকিস্তানী বাহিনী বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। তার আগে চলে লুটপাট। গ্রামের বেশিরভাগ ঘরবাড়ির ছাউনি ছিল খড়কুটো দিয়ে। কাজেই বৈশাখের প্রচ- তাপে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে আজগড়া।

এরপরে পাকিস্তানী বাহিনীর একটি দল উপস্থিত হয় আজগড়ার হীরালাল গোস্বামীর বাড়িতে। ৭০ বছর বয়সী হীরালাল এবং তার স্ত্রী ভাবতেই পারেনি যে এই বয়সে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাদের মারতে পারে। এই বিশ্বাসে বাড়ির অন্য সদস্যরা বাড়ি ছেড়ে পালালেও তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়িতে থেকে যান। আরও সঙ্গে ছিল ৮-৯ বছর বয়সী পৌত্র বিশ্বনাথ গোস্বামী। কিন্তু পাকিস্তানী বাহিনী তার বাড়িতে ঢুকে তাকেও গুলি করতে উদ্যত হয়। তখন তিনি পাকিস্তানী বাহিনীর কাছে তার স্ত্রী এবং তার প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন। পাকিস্তানী বাহিনী তার স্ত্রী এবং তাকে বলল- ভাগ যা। এই কৃতজ্ঞতার প্রতিদান হিসেবে বৃদ্ধ হীরালাল পাকিস্তানী বাহিনীর মুখো হয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে তাদের প্রণাম করতে গিয়েছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী মিলিটারিরা তাকে গুলি করে, মাটিতে সেভাবেই উপুড় হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন হীরালাল। দূর থেকে স্বামীর এই করুণ পরিণতি চেয়ে চেয়ে দেখলেন তার স্ত্রী, হাতে ধরা ছিল তার নাবালক পৌত্র বিশ্বনাথ গোস্বামী। দাদুর এই পরিণতি তাকে ভীষণ অসহায় ও ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলল। বৃদ্ধ হীরালালের স্ত্রী স্বামীর লাশ ফেলে পৌত্রের কথা চিন্তা করে তাকে হাতে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এরপর পাকিস্তানী বাহিনী তার বাড়িটি আগুন লাগিয়ে দিল।

পাকিস্তানী বাহিনী এবং এদেশে তাদের দোসররা গ্রাম থেকে চলে যাওয়ার পরে নিরীহ এই লোকগুলো যখন আবার বাড়ি ফিরে এলো, তখন তারা এক বেদনাভরা ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে পায়Ñ যা তাদের বাঁচার আশাটুকুও বিলীন করে দেয়। একদিকে যেখানে সেখানে পড়ে আছে প্রিয়জনের গুলিবিদ্ধ খ--বিখ- মৃতদেহ। কারও হাত উড়ে গেছে তো কারও ফুসফুস বেরিয়ে গেছে, বীভৎস সব মৃতদেহ। অন্যদিকে যে কাপড়টা পরে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছিল বাড়ি এসে দেখে সম্বল বলতে ঐ টুকুই আছে। না পারছে কাপড়টা পরিবর্তন করতে, না আছে খাবার মতো ঘরে কিছু, না আছে ঘর। সবাই দিশেহারা। প্রিয়জনের লাশগুলো সৎকার করার মতো শক্তিটুকুও বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর ছিল না। কোলের অবুঝ শিশুটিও ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর। তার মুখে কিছু দিবে এমন কিছু অবশিষ্ট নেই। এ সময়ে মানবিক টানে কাছে এগিয়ে আসলেন কিছু মুসলিম সম্প্রদায়ের লোক। তারাই মৃতদেহগুলো কোন রকমে কয়েকটা গর্ত খুঁড়ে পুঁতে রাখে। তারা সর্বস্বহারা লোকগুলোর জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করলেন, ব্যবস্থা করলেন কিছু আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র।

অনেকে চলে যায় ভারতে। কেউ ভিটেমাটির মায়ায় এবং ভাল মনের কিছু মুসলিম ভাইদের আশ্বাসে থেকে যায় নিজের ভিটেয়। কিন্তু আশ্বাস বা মায়ায় যারা ছিল তারা শান্তিতে থাকতে পারেনি। স্থাবর অস্থাবর স¤পদ থেকে শুরু করে নারী- যা রাজাকার এবং পাকিস্তানী মিলিটারিদের প্রয়োজন, তা তাদের দিতে হতো। নারীর ক্ষেত্রে সাধারণত বাইরের গ্রাম থেকে আসা মেয়েগুলোকে তারা নিশানা করতো। খুলনা শহরের অনেক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের যুবতী নারী এবং মেয়েদের এই গ্রামে রেখে গিয়েছিলো। এরাই ছিলো পাকিস্তানি দোসরদের নিশানা। সেদিনের সেই ভয়ালচিত্র আজও আজগড়াবাসী ভোলেনি।

১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের উদ্যোগে প্রকাশিত গণহত্যা-নির্যাতন নির্ঘণ্ট গ্রন্থমালায় আজগড়া গণহত্যা নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সরকারী বিএল কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অমল কুমার গাইন লিখিত সেই গ্রন্থে আজগড়া গণহত্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

লেখক : গবেষণা কর্মকর্তা, গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র, খুলনা

সৌজন্যেঃ জনকণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত