জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া: আদৌ কি সফলতার ‍মুখ দেখবে?

11446

Published on সেপ্টেম্বর 23, 2018
  • Details Image

মো: সাখাওয়াত হোসেনঃ

নিজে সাংবাদিক না হলেও সাংবাদিক সমাজের সাথে আমার সখ্যতা দীর্ঘদিনের। তারই সুবাধে মাঝে মধ্যে জাতীয় প্রেস ক্লাবে যাই, আড্ডায় জাতীয় রাজনীতি ও অন্যান্য সমসাময়িক বিষয়ে নানামুখী আলোচনায় উপস্থিত হয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞানগর্ভ আলোকপাত ও তথ্য উপাত্ত জানতে পারি। তারই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে গিয়েছিলাম সিনিয়র এক সাংবাদিকের আহবানে এবং সেদিনই জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতারা সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলন শুরু হওয়ার আগে ঐক্য প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি চোখে না পড়লে চোখে পড়েছিলো সাংবাদিক ভাইদের সরব উপস্থিতি। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সংবাদ কর্মীদের কল্যাণে অনেকেই বুঝতে সক্ষম হয় সেখানে কোন গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিক সম্মেলন হতে যাচ্ছে। তবে ঐক্য প্রক্রিয়ার সাথে সংযুক্ত নেতাদের যে মন্তব্য ও তোড়জোড় তাতে তাদের সমর্থনে প্রেস ক্লাব চত্ত্বরে কর্মী সমর্থকদের ব্যাপক উপস্থিতি থাকা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু উল্লেখ করার মতো সমর্থকদের অনুপস্থিতি ঐক্য প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ অবস্থা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক করে।

তবে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, নির্বাচনের প্রাক্কালে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট নেতারা সংবাদের শিরোনাম হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। অর্থাৎ মিডিয়ার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পেরেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের সত্যিকার মালিক বাংলার জনগণের কতটুকু মনোযোগ ও আস্থা অর্জন করতে পারবেন তার উপরই নির্ভর করছে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ। কারণ রাজনৈতিক মাঠ বড়ই বিচিত্র, কখন যে নেতারা ডিগবাজি মেরে রং পরিবর্তন করে ফেলেন তা আন্দাজ করা বড়ই মুশকিল। তাছাড়া কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতাদের ডিগবাজির চরিত্র আমরা দেখে আসছি এবং সবচেয়ে বড় কথা ঐক্য প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই দলছুট। ঢাকা মহানগরের নাট্যমঞ্চে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া কর্তৃক আয়োজিত নাগরিক সমাবেশে সে রকম নেতাদের উপস্থিতি রাজনীতি সচেতন মানুষদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে অনেকাংশে।

তবে জাতীয় ঐক্য বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে যে কারণগুলি সাধারণ জনগণের সামনে চলে আসছে তার মধ্যে বেশ কয়েকটি কারণ নিম্নরূপঃ

প্রথমত: নতুন একটি দল কিংবা সংগঠন দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে পূর্ব শর্ত হচ্ছে জনগণ তথা কর্মী সমর্থকদের একত্রিত করে সামগ্রিক পরিবেশ পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোকপাত করা এবং জনগণের মধ্যে রাজনীতি ও সরকার ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা চেতনা ও ভাবনার উদ্রেক ঘটানো। কেননা, সংগঠন প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও জাতীয় জীবনে এর প্রভাব কতটুকু পড়তে পারে তার নিমিষেই কিন্তু বিশ্লেষকরা ঐ সংগঠন তথা দল সম্বন্ধে তাদের মতামত ব্যক্ত করে থাকেন। মনে হচ্ছে, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া আপাতত সে পথে হাঁটতে পারছে না। তাছাড়া নির্বাচনের পূর্বে আমাদের দেশে ছোট দলের সাথে বড় দলের এবং বড় দলের সাথে ছোট দলের ঐক্য হয়ে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ঐক্য প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক নেতারই কোন রাজনৈতিক দল নেই। আবার যাদের দল রয়েছে হলফ করে বলতে পারি সারাদেশে বলার মতো তাদের দলের কোন কমিটি নেই। এসব কিছুই বিচার বিশ্লেষণ করছে নতুন প্রজন্মের ভোটাররা।

দ্বিতীয়ত: রাজনৈতিক প্লাটফর্ম দাঁড় করানোটা একটা সময় সাপেক্ষ ও জটিল বিষয়। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জনগণকে একীভূত করে সুগঠিত কাঠামোর উপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরি করা হয়ে থাকে। সে বিবেচনায় জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার গঠন ও তার নিমিষে প্রচার প্রচারণা অনেকটা দুরভিসন্ধিমূলক মনে হচ্ছে। কারণ, সব পেশা শ্রেণির মানুষের কাছে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার বার্তা পৌঁছানো এবং জনগণের মধ্যে ঐক্য প্রক্রিয়ার বাস্তবায়নের ফিরিস্তি প্রদান করা হয়তো নির্বাচনের পূর্বে সম্ভব হবে না। কাজেই, যে কোন ঐক্য প্রক্রিয়া তড়িঘড়ি করে গঠন করা সম্ভব নয়। ঐক্য প্রক্রিয়ার গঠনেও খুব তাড়াহুড়ো বিষয়টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আবার এও লক্ষ্যণীয়, নির্বাচনকে সামনে রেখে কতিপয় ব্যক্তিবর্গ নতুন নতুন রাজনৈতিক খেলায় মেতে উঠে।

তৃতীয়ত: ঐক্য প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট একজন সিনিয়র রাজনীতিবিদ ১৫ সেপ্টেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে অসুস্থতার অজুহাতে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হতে পারে নি বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর এসেছে। আবার এও জানা যাচ্ছে, গঠনতন্ত্রে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংক্রান্তে কিছু একটা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। খরবগুলো বিশ্বস্ত না হলেও যেহেতু সংবাদ মাধ্যমে এসেছে সেহেতু খবরের সত্যতা সম্বন্ধে উড়িয়ে দেওয়ার অবকাশ থাকে না। গঠন প্রক্রিয়ার শুরুতেই যেহেতু অবিশ্বস্থতা শুরু হয়েছে শেষত এটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় কিনা সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ, বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে কোন সংগঠন দাঁড় হতে পারে না সেখানে রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠার জন্য আরো বেশি পরিমাণে স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা থাকতে হয়। কাজেই, নেতারাই যেখানে ঐক্যের বাতায়ন দিতে পারছে না সেখানে আমজনতার পক্ষে তাদের সমর্থন জানানো কতটা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে, সময়ই সেটা বলে দিবে।

চতুর্থত: জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নাম কি হতে পারে এবং নেতৃত্বে কে থাকবেন সে বিষয়গুলো এখনো সুরাহা হয় নি। আমাদের জনগণ সব বিষয়ে খবরাখবর রাখে এবং ইন্টারনেট প্রযুক্তির সহায়তায় বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে থাকে। কাজেই যে দলটি আগামী দুই-আড়াই মাস পরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে এবং সে দলটি ও তাদের সাথে সংশ্লিষ্টরা এখনো তাদের ঐক্য প্রক্রিয়ার নাম কি হবে এবং নেতৃত্বে কে থাকবে তার উপায়ন্তর নির্ণয় করতে পারেননি সে ঐক্য প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই তাই শঙ্কিত।

পঞ্চমত: আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক এগারোর ইতিহাস অত্যন্ত কলঙ্কজনক। অনেকেই মন্তব্য এবং বিশ্বাস করে থাকেন, এক এগারোর সরকার বাংলাদেশকে নানাভাবে পিছিয়ে দিয়ে গেছে। বিশেষ করে তরুণ সমাজ এক এগারোর কুশীলবদের ঘৃণার চোখে দেখে। কেননা তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেও সেটি মূলত ছিল সেনাশাসিত সরকার। মহানগরের নাট্যমঞ্চে জাতীয় ঐক্যের সমাবেশে এক এগারোর অন্যতম একজন কুশীলবের সাথে যেভাবে ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতারা হাত উঁচিয়ে উপস্থিত মানুষদের অভিবাদন জানালেন তাতে করে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া গঠিত হলে ভবিষ্যৎ কি হতে পারে সে সম্বন্ধে অনেকের ভাবনা চিন্তা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। হলফ করে বলা যায় সে ভাবনা চিন্তা অবশ্যই নেতিবাচক হবে।

শেষত: যে কয়েকটি দল ও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার যাত্রা শুরু হওয়ার কথা ছিল তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি দল এখনো ঐক্য প্রক্রিয়ার সাথে সংযুক্ত হয় নি। ভেতরের খবরাখবর আমরা যেমন জানি না তবে অনুমান করে বলা যায় হয়তো কোন ত্রুটি বিচ্যুতি দেখা দিয়েছে নয়তো কেনই বা আসলো না শুরুর দিকে একত্রে থাকা দল ও ব্যক্তিবর্গরা। শুরুতেই যেখানে গলদ দেখা দিয়েছে সুতরাং সে প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ খুব একটা সুখকর হবেই না বলে মনে হয়। কাজেই, উপর্যুক্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও আলোচনায় বলা যায়, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে যে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচল ও ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের মধ্যকার আস্থার সংকট লক্ষ্য করা যাচ্ছে সেটি ‍খুব বেশি দিন একত্রে নাও দেখা যেতে পারে। কারণ, প্রক্রিয়াটির চলমান ও বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য প্রয়োজনীয় বেশ কিছু উপাদানের অভাব সুস্পষ্ট।

লেখক: প্রভাষক, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত