বঙ্গবন্ধু ও বর্তমান রাজনীতি

2306

Published on আগস্ট 13, 2018
  • Details Image

আহমেদ আমিনুল ইসলামঃ

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতালোভী ষড়যন্ত্রকারীরা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে শুধু হত্যাই করা হয়নি- এই বাংলার বুক থেকে, বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় থেকে তাঁর নাম নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু হয়নি- তাঁর মৃত্যু হতে পারে না। এ দেশের ইতিহাস থেকে তাঁকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হয়নি, হবেও না কখনো। কোটি বাঙালির হৃদয় থেকে, এই ভূগোল বাংলার ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা নিশ্চিহ্ন করার যে ষড়যন্ত্র ক্ষমতালোভীরা করেছিল তা ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষমতালোভী ষড়যন্ত্রকারীদের সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে এ দেশের মানুষ। তারা নিঃসঙ্কোচে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে গ্রহণ ও বরণ করে নিয়েছে। প্রকৃতি নিজস্ব নিয়মে প্রতিশোধ গ্রহণের মাধ্যমে ক্ষমতালোভী ও ষড়যন্ত্রকারীদেরই নাম-নিশানা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে।

বাঙালি ও বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নেতা হয়ে জন্মগ্রহণ করেননি। তিনি এ দেশের মানুষের নেতা হয়ে উঠেছেন, মানুষের সঙ্গে মিশে তাদের সমস্যা, সঙ্কট ও সংগ্রামের অন্তর্গত পাঠ গ্রহণ করে তিনি বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন; হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির বন্ধু। এর জন্য দীর্ঘ পথ তাঁকে অতিক্রম করতে হয়েছে। আমরা জানি, সেই পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। তবে কণ্টকাকীর্ণ সেই পথকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন কেবল এ দেশের মানুষের মুক্তির জন্য। শৈশব থেকেই তিনি মানুষের সঙ্গে মিশেছেন উদার ও মানবিক এক মন নিয়ে। সাধারণের সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনাকে তিনি আন্তরিকভাবে অনুভবেও ছিলেন সচেষ্ট। মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও হাসি-আনন্দকে বুঝতে বুঝতে এবং সেসব দুঃখ-কষ্ট ও হাসি-আনন্দের অংশ ভাগ করে নিতে নিতে শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে উঠেছিলেন তাদেরই বন্ধু ও স্বজন- এক কথায় ভরসা ও আশ্রয়। আবার, সবার শতসহ¯্র দুঃখ-কষ্ট ও বেদনার দীর্ঘ অভিযোগ-আবদার শুনতে শুনতে বঙ্গবন্ধইু প্রথম উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, এ দেশের মানুষের এত ব্যাপক অভিযোগের পশ্চাতে নিহিত ছিল রাজনীতির বিষবাষ্প- তথা সুগভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শৃঙ্খল। সেই শৃঙ্খল ভাঙার বিষয়েও তিনি সচেতন ছিলেন। শৃঙ্খল ভাঙার জন্য তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন। এ দেশের গণমানুষের সঙ্গে গভীরতর প্রত্যয়ে মিশেছেন। ছোটবেলার খেলার মাঠ, স্কুল ও কলেজের পরিমণ্ডল পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সঙ্গে অন্তর খুলে মেশার এই সৎগুণটি ক্রমেই তাঁকে বিস্তৃত পটভূমি দান করেছে। সেই পটভূমি তাঁর অন্তরাত্মাকেও করেছে প্রসারিত। মানুষের জন্য, দেশের জন্য দিনের পর দিন কারাগারে কাটিয়েছেন জীবনের সমৃদ্ধ সময়- যে সময় সাধারণ মানুষ পরিবারে ¯েœহ-মমতা ও ভালোবাসার মানুষগুলোর সাহচর্যেই কাটিয়ে থাকে। তিনি অসাধারণ ছিলেন বলেই সাধারণ মানুষের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার বাস্তব এক রূপ দেয়ার লক্ষ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিরন্তর নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। জাতির এক ক্রান্তিকাল এবং রাজনৈতিক এক তুঙ্গ মুহূর্তে তিনি তার অবিনাশী আহ্বানে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। এমন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বিশ^ ইতিহাসেও বিরল।

বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের ১৮ জন সদস্যসহ হত্যা করা হয়েছিল। এই ১৮ সদস্যের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন সাত বছরের শিশু রাসেল। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার এই আগস্ট তাই বাঙালির কাছে শোকের মাস। আগস্ট ভয়াবহতম শোকের মাস। পৃথিবীর ইতিহাসে এরূপ নির্মম ও নিষ্ঠুর ঘটনা কোনো আধুনিক রাষ্ট্রে ঘটেনি। তাই আগস্টকে আমরা বলছি শোকের মাস, তরুণ প্রজন্মকে এই বার্তাই আমরা দিতে চাই বিশে^র ইতিহাসে এমন পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের মতো নারকীয় ঘটনা বিরল। তাই বাঙালির হৃদয়ে আগস্টের শোক নিরন্তর। আমাদের জাতিসত্তার ইতিহাস ও বাঙালির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের দিকে তাকালে উপলব্ধি সম্ভব যে, আগস্টের মতো শোকের মাস আর হয় না। এই শোকের কারণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের গভীরেই প্রোথিত। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও উদাত্ত আহ্বানে একটি দেশের কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমরাও স্বাধীনভাবে নিজেদের কথা বলতে পারছি। অথচ ক্ষমতালোভীরা বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে রাতের অন্ধকারে সপরিবারে হত্যা করেছে। হত্যাকারীদের উত্তরসূরিরা এখনো সক্রিয়। আজ তেতাল্লিশ বছর পরে সেই চিহ্নিত অপশক্তির উত্তরসূরিরা এই মহান নেতাকে নিয়ে নোংরা ও অশ্লীল কথা প্রচারের সুযোগ নিয়েছে। তারা স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিশু-কিশোরদের ‘নিরাপদ সড়ক’ আন্দোলনের ভেতর প্রবেশ করে প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বাধীনতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। শিশুদের সম্মুখে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা সম্পর্কে বিরূপ ‘ইমেজ’ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সুচিন্তিতভাবে উঠেপড়ে লেগেছে! তারা এ ঘটনাটি ঘটাচ্ছে শোকাবহ আগস্টের বেদনার্ত সময়ে। কিন্তু তরুণ প্রজন্মকে অবশ্যই ভাবতে হবে যে, দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে যারা এরূপ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে তারা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি নয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলকারীরা একটি আদর্শকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল একাত্তরের ১৫ আগস্টে। আদর্শটি ছিল বাঙালিত্বের; আবার এ শুধু আদর্শই ছিল না- এ ছিল বাঙালির আত্মঅহংকারেরও মূলমন্ত্র। সাত বছরের শিশু রাসেলসহ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতালোভীরা যে রাষ্ট্রতন্ত্র চালু করেছিল সেখানে আমরা আমাদের বাঙালিত্বের গর্বিত অহংকারের অপমৃত্যু দেখেছি। সমগ্র জীবনের রাজনৈতিক সাধনায় বঙ্গবন্ধু যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উদ্বোধন এদেশের মানুষের মনোজগতে জাগ্রত করে তুলেছিলেন এবং সমগ্র বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় লব্ধ এই অসাম্প্রদায়িক চেতনাটিরও অপমৃত্যু হতে দেখেছি। সেনা ও সামরিকতন্ত্রের কাছে জিম্মি থাকা রাষ্ট্রে আমরা সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ও মানবিক শক্তি বিলুপ্ত হতে দেখেছি। দেখেছি ধর্মীয় লেবাসে পরাজিত পাকিস্তানপন্থিরাই এদেশের রাজনীতির মাঠ ও মানুষের মগজে নানা কায়দা ও ফন্দি-ফিকিরে পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, সাম্প্রতিকের স্কুল শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক’ আন্দোলনকে উপজীব্য করে নতুনরূপে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে আশ্রয় করে চিহ্নিত এই গোষ্ঠীটিই সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ক্ষমতার লোভ, পদমর্যাদা ভোগ, আর ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ তন্ত্রের সামরিক চোখ রাঙানোর কাছে একে একে বশ্যতা শিকার করে নেয়া মেরুদণ্ডহীন ও আত্মসমর্পণকারী নেতাকর্মীদের উত্তরসূরিরাই আজ শিশুদের ‘নিরাপদ সড়ক’ আন্দোলনকে পর্যন্ত কায়েমি স্বার্থে দখল করে নিয়েছে। আর শিশুদের মনোজগতে বাঙালি, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা এবং বলার অপেক্ষা রাখে না, হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে গঠিত বাঙালিত্বের অন্তর্গত মানসে বিরাজিত অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সুকৌশলে অনবরত আঘাত করে চলেছে। আমরা জর্জরিত, উদ্বিগ্ন এবং ভাবিত হই নবপ্রজন্মের শিশু-কিশোরদের বিভ্রান্ত করার এই অসুস্থ প্রবণতা দেখে। তরুণ প্রজন্মকে সেসব স্বার্থান্বেষীর ছোবল থেকে সাবধান থাকতে হবে।

আগস্ট এক অন্তহীন বেদনার মাস। বঙ্গবন্ধু হত্যার চার দশক পরে তাঁর ৪৩তম শাহাদাতবার্ষিকীর প্রাক্কালে এই বেদনা বোধের তীব্রতা এবার ভিন্নভাবে উপলব্ধি সম্ভব হলো। বুঝতে পারলাম নতুন প্রজন্মের মধ্যেও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত মিথ্যা বিষবাষ্প ছড়ানো হয়েছে, হচ্ছেও। শহীদ রমিজ উদ্দিন স্কুল ও কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সাম্প্রতিককালের ‘নিরাপদ সড়ক’ আন্দোলনের ভেতর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ও পাকিস্তানি শাসকদের উত্তরসূরিরা কৌশলে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু, জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবার ও সরকারকে উদ্দেশ্য করে নানারূপ মিথ্যা ও অশ্লীল অপপ্রচার চালিয়েছে। জাতির পিতা ও বাংলাদেশের স্থপতিকে উদ্দেশ্য করে এমন হীন মন্তব্যের প্রচার তাঁকে পুনর্বার হত্যা করার চেয়েও কম নিষ্ঠুর নয়। বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিষবাষ্প ছড়ানোর কাজে চিহ্নিত মহলটি এখনো তৎপর। বঙ্গবন্ধু হত্যার মাসে যেখানে সমগ্র জাতির কাঁদবার কথা সেখানে চিহ্নিত মহলটির এমন জঘন্য প্রচারণা দেখে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সৃষ্ট বেদনায় পুনরায় জর্জরিত হই। তবু মথিত হৃদয়ের কান্নাকে জমিয়ে রেখে সেই শক্তির উদ্বোধন আমাদের আজ বড় প্রয়োজন যা বাঙালির প্রকৃত ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উৎসমূলে ধাবিত। নবরূপে উদ্বোধিত এই শক্তির মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণে বিরত থাকার কোনো বাঙালিরই অবকাশ নেই। পুনশ্চ বলে রাখা ভালো যে, মুজিব কোট গায়ে জড়িয়েও অনেক মন্ত্রী-এমপি বঙ্গবন্ধুর দীক্ষামন্ত্র থেকে সরে গিয়েছেন- যা আমাদের বিস্মিত করে!

শত অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র থাকার পরও এই আগস্টেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ^াসীদের শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ‘নিরাপদ সড়ক’-এর কথা বলতে এসে শিশু-কিশোররা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন জাতিকে দেখাল তা কিন্তু এক পরিচ্ছন্ন সোনার বাংলার স্বপ্ন। উপলব্ধি করি, এই স্বপ্নইতো ছিল বঙ্গবন্ধুর- যেখানে কোনো অন্যায়-অনাচার-অবিচার প্রশ্রয় পাবে না। শিশুরা আজ হয়তো সড়ক-মহাসড়কে দাঁড়িয়ে কেবল গাড়ি ও চালকের লাইসেন্স চেক করছে। আমরা এটিকে প্রতীকী হিসেবে ধরে নিতে পারি। এরপর এই প্রজন্মের প্রশ্নের মুখেই আমরা যদি আমাদের জীবনের অন্যান্য ন্যায়-অন্যায়ের মুখোমুখি হই এবং আত্মশুদ্ধির ব্রত গ্রহণ করি তবে সেই বাংলাদেশই তো হবে দুর্নীতিমুক্ত, সুশৃঙ্খল- এককথায় সোনার বাংলা। সড়কে শিশুদের লাইসেন্স পরীক্ষার বিষয়টি প্রতীকী হিসেবে গ্রহণ করে আমরা যদি আমাদের ব্যক্তিজীবন ও কর্মস্থলে ন্যায়-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারি তবেই তো দেশটি দুর্নীতিমুক্ত হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় সোনার বাংলা। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ ও বঙ্গবন্ধুর শান্তির আশ্রয়। আগস্টের বেদনাবহ শোক অন্তরে ধারণ করে নতুন প্রজন্মের কাছে পাওয়া প্রেরণা নিয়ে সবার মধ্যে সোনার বাংলা গড়ার শক্তি জাগ্রত করার কোনো বিকল্প নেই।

লেখকঃ অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যেঃ ভোরের কাগজ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত