জি-৭ আউটরিচ সম্মেলনে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৪ প্রস্তাব

19453

Published on জুন 10, 2018
  • Details Image
  • Details Image

জি-সেভেন আউটরিচ সম্মেলনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারে তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনসহ চার দফা প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

শনিবার কানাডার কেবেকে জি-সেভেন আউটরিচ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের সম্মেলনে শেখ হাসিনা এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন।

জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের প্রধান ক্রিস্টিন লগার্দও ছিলেন সেখানে।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবগুলো হল-

# জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও স্থায়ী প্রত্যাবর্তন নিশ্চিতে বাংলাদেশের সঙ্গে হওয়া দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে রাজি করাতে হবে।

# মিয়ানমারকে অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে রাখাইন পরামর্শক কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে করতে হবে।

# রাখাইনে নিপীড়নের ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে যথাযথ নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব গ্রহণের জন্য কাজ করতে হবে।

# রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো অমানবিক নিপীড়ন বা মানবাধিকার লংঘনের জন্য জবাবদিহি ও বিচার নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ।

মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চার লাখের মতো মানুষ কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে। এরমধ্যে গতবছর ২৫ অগাস্ট রাখাইনে নতুন করে সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরুর পর সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে এসেছে আরও সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা।

জাতিসংঘ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোহিঙ্গা সঙ্কটকে এশিয়ার এ অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে গত বছরের ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের সঙ্গে একটি সম্মতিপত্র সই করে বাংলাদেশ। এর ভিত্তিতে দুই দেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন এবং ১৬ জানুয়ারি ওই গ্রুপের প্রথম বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিভিন্ন বিষয় ঠিক করে ‘ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট’ স্বাক্ষরিত হয়।

এরপর প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সরকারকে আট হাজারের মতো রোহিঙ্গার একটি তালিকা দেওয়া হলেও এখনও কেউ রাখাইনে ফিরতে পারেনি।

এই সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি এ কথাটি আগেও বলেছি, আবার বলছি রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণ মিয়ানমারে, মিয়ানমারকেই এর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। মিয়ানমারের নাগরিকরা যাতে তাদের নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারে, যেখানে তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী বসবাস করে আসছে।”

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও স্থায়ী প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে আমরা এর সঙ্গে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরকে সম্পৃক্ত রেখেছি।”

তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণ চিহ্নিত করা এবং বারবার বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল থামাতে মিয়ানমার সরকারের উচিত কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও বেশি সহযোগিতা প্রয়োজন, বিশেষ করে জি-৭ দেশগুলোর কাছ থেকে।”

প্রায় ১১ লাখ মিয়ানমারের নাগরিকের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “নিজেদের দেশে জাতিগত নির্মূলের মুখোমুখি হয়ে রোহিঙ্গারা তাদের জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আমাদের জনগণ তাদের ঘরবাড়ি খুলে দিয়েছে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে দুর্দশাগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাদের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করেছে।”

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সামালে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের পাশে উদারভাবে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা সরবরাহ করেছে। ১২২টি স্থানীয়, আর্ন্তজাতিক সংস্থা ও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করছে।”

এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ধন্যবাদও জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, “সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজস্ব সম্পদ দিয়ে আমরা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আশ্রয়, চিকিৎসাসহ অন্যান্য মৌলিক সেবা দিয়ে যাচ্ছি। বর্ষা ও সাইক্লোনের এ মৌসুমে বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছি।”

এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাষাণচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এই জায়গাটি বসবাসযোগ্য, নিরাপদ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকবে। সেখানে বসবাস এবং জীবনধারণের অধিকতর ভালো সুযোগ থাকবে।”

বক্তব্যে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কৃষি, স্বাস্থ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কারিগরি সহায়তার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

ব্লু ইকোনোমির (সমুদ্র অর্থনীতি) মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে জনজীবনে পরিবর্তন আনতে জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর কাছে নেতৃত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করেন তিনি।

স্থানীয় সময় শনিবার বেলা ১২টায় জি-সেভেন আউটরিচ সম্মেলনস্থল কেবেকের লা মালবের লে মানোর রিশেলো হোটেলে পৌঁছালে শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানান কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।

এ সময় দুই প্রধানমন্ত্রী কুশল বিনিময় করেন এবং আনুষ্ঠানিক ফটোসেশনে অংশ নেন।

কানাডার প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে জি-সেভেন আউটরিচ সম্মেলনে যোগ দিতে শুক্রবার দুপুরে কেবেকে পৌঁছান শেখ হাসিনা। সন্ধ্যায় জি-সেভেন আউটরিচ সম্মেলনে যোগ দিতে আসা নেতাদের সম্মানে কানাডার গভর্নর জেনারেলের দেওয়া নৈশভোজে অংশ নেন তিনি।

কেবেকে হোটেল শ্যাতো ফঁতেনেক-এ অবস্থান করছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

বিশ্ব অর্থনীতির সাত পরাশক্তির জোট জি-সেভেনের সম্মেলনের পাশাপাশি আঞ্চলিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিষয়ে আলোচনার জন্য জোটের বাইরে থেকে বিভিন্ন দেশকে আলাদা বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। একেই বলা হয় জি-সেভেন আউটরিচ মিটিং।

সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও জি টোয়েন্টি জোটের বর্তমান সভাপতি আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট; ক্যারিবিয়ান কমিউনিটির চেয়ার হাইতির প্রেসিডেন্ট; জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী; কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট; মার্শাল আইল্যান্ডসের প্রেসিডেন্ট; নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী; আফ্রিকান ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ার রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট; সেনেগালের প্রেসিডেন্ট; সেসেলসের প্রেসিডেন্ট; দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট; ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী; অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) সেক্রেটারি জেনারেল; জাতিসংঘ মহাসচিব এবং বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে আমন্ত্রণ জানায় কানাডা সরকার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর আগে ২০১৬ সালে জাপানে এবং ২০০১ সালে ইতালিতে জি সেভেন আউটরিচ সম্মেলনে যোগ দেন। কানাডা ছাড়া জি সেভেনের বাকি ছয় সদস্য দেশ হল ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র।

সফরের তৃতীয় দিন রোববার সকালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে বৈঠকের পর টরন্টো যাবেন শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।

টরন্টো থেকে প্রধানমন্ত্রী দেশের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে সোমবার সকালে কানাডার মিয়ানমার বিষয়ক দূত বব রে, কানাডার সাসকাচোয়ান প্রদেশের উপ প্রধানমন্ত্রী জেরেমি হ্যারিসন এবং কমার্শিয়াল কোঅপারেশন অব কানাডার প্রেসিডেন্ট মার্টিন জাবলোকি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।

কানাডার স্থানীয় সময় সোমবার দুপুরে টরন্টো থেকে দেশের পথে রওনা হবেন প্রধানমন্ত্রী। দুবাইয়ে যাত্রাবিরতি করে মঙ্গলবার রাতে তার ঢাকা পৌঁছানোর কথা রয়েছে।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত