বিদগ্ধজনেরা অনেক কিছু ভুলে যানঃ সুভাষ সিংহ রায়

2463

Published on ফেব্রুয়ারি 18, 2018
  • Details Image

সুযোগ পেলেই বিদগ্ধজনেরা আওয়ামী লীগের খুঁত ধরার চেষ্টা করেন। এখনও কেউ কেউ মনে করেন আওয়ামী লীগ যেন নিজে হেরে গিয়ে অন্যকে ক্ষমতায় বসায়। যদিও তাদের কেউ কেউ স্বীকার করে থাকেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে অতীতে ভাল আচরণ করা হয়নি। অথচ তারাই আশা করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেন বিরোধীদের সঙ্গে খুব ভাল আচরণ করে। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে বিদগ্ধজনেরা অনেক অনেক ভাল প্রত্যাশা করেন। কিন্তু অতীতের ক্ষত কি সহজে দূর হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ঘোর অমানিশার অন্ধকারের কথা নাইবা বললাম। তখন ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিয়ে বিদগ্ধজনেরা সোচ্চার হননি। মহিউদ্দিন আহমেদের লেখা ‘বিএনপি সময়-অসময়’ থেকে পাঠক জানতে পারবেন কি দুর্গমগিরি কান্তার মরুপথ আওয়ামী লীগকে পাড়ি দিতে হয়েছে। সেই বই থেকে উৎকলন করছি ‘মৃত মুজিবকে মোকাবিলা করার জন্য ৪ আগস্ট (১৯৭৬) ইতোপূর্বে জারি করা রাজনৈতিক দলবিধি সংশোধন করা হয়। প্রথমে জারি করা দলবিধিতে ছিল ‘ক্ষতিকর কার্যকলাপে’ লিপ্ত কোন সংগঠনকে নিবন্ধন দেয়া হবে না। ৪ আগস্টের সংশোধনীতে ক্ষতিকর কার্যকলাপের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ১০ উপদফার উল্লেখ করা হয়। ১০ নম্বর উপদফায় বলা হয় : কোন জীবিত বা মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি বা উৎসাহিত করিতে পারে বলিয়া সম্ভাবনা রহিয়াছে।’ বোঝায় যায় সেই সময় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডটা কেমন ছিল। কেননা তখন তো বহুদলীয় গণতন্ত্রের বটিকা খেয়ে নেশায় বুঁদ হয়েছিলেন। কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান সে সময় লিখেছিলেন, ‘দাসত্বের খোয়ারি নেশা অত সহজে কাটে না।’ আওয়ামী লীগের বক্তৃতা প্রেস বিজ্ঞপ্তিও পত্রিকাগুলো ছাপতে চাইত না। আর এখন ‘জামায়াতে ইসলাম’ কোন পত্রিকায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি না পাঠালেও তাদের ওয়েব সাইট থেকে সংবাদ নিয়ে তা প্রচার করে থাকে। ঘোর দুর্দিনেও আওয়ামী লীগ তার জন্মসূত্রে পাওয়া সংগ্রামী চেতনা থেকে বিন্দুমাত্র সরে আসার চেষ্টা করেনি। আওয়ামী লীগ নিজের ক্ষতি সাধন করে জাতীয় ঐক্যের রাজনীতির পথ দেখিয়েছে। নির্যাতন-নিপীড়নের কথা ভুলেও আওয়ামী লীগ মিলেমিশে চলার চেষ্টা করেছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের কথা একটু ভেবে দেখি না কেন। বিএনপি কেন, দেশের কেউ তখন ভাবেননি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবে না। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বেশি ভোট (প্রাপ্ত মোট ভোট, ভোটের শতাংশ) পেয়েও ক্ষমতায় যেতে পারেনি। ষড়যন্ত্রের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা হয়েছিল। কারা ষড়যন্ত্র করেছিল, কীভাবে করেছিল সেটা অনেক বড় আলোচনা। যাহোক, আওয়ামী লীগের জন্যে ছিল সেটা বড় রকমের ধাক্কা। তারপরও আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। পঞ্চম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল। সংসদীয় ধারার রাজনীতির কথা বলে এসেছে বলে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থেকে সংসদে বিল এনেছিল। অপেক্ষাকৃত সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী বিএনপি কিন্তু তখন জাতীয় সংসদে বিল আনেনি। এ অধিবেশনে আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে প্রথম ওয়াক আউট করে ৭ এপ্রিল। এর কারণ ছিল কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনার ক্রমিক নম্বর ছিল ছয়। এমনকি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পর ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কত জটিল পরিস্থিতিতে অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল তা এখন ভেবে দেখেন না। অনেকে তো জানেনই না; আবার যারা জানেন তারা স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ করেন। ১৯৭৫ সালের আগস্ট থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে দুর্গমগিরি কান্তার মরুপথ পাড়ি দিতে হয়েছে। যে বিএনপি আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করবার জন্য কি-না করেছে, সেই বিএনপিকে মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করেছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বেশি ভোট পেয়ে ক্ষমতায় যেতে না পারলেও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা থেকে একবিন্দু সরে আসেনি। আমাদের দেশের কেউ কেউ হঠাৎ করে বিশুদ্ধবাদী হতে চায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তাদের বিশুদ্ধবাদিতার যেন অন্ত নেই। তারা সকল কাজেই আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ভালটাই প্রত্যাশা করে; অথচ আওয়ামী লীগের সামান্য ত্রুটি নিয়ে আকাশ বিদীর্ণ করে। বিদগ্ধজনেরা কি ভেবে দেখেছেন এই অচলাবস্থা কোথা থেকে শুরু? ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচন শুধু আওয়ামী লীগ কেন সমগ্র বাংলাদেশ ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছিল। একই সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ মনে করেছিল মাগুরা উপনির্বাচনে তাদের পরাজয়ের পেছনে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের কারসাজি ছিল। নির্বাচন কমিশন অভিযোগের নামকাওয়াস্তে তদন্ত করে। সে সময় পুনরায় মাগুরা উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানানো হয়েছিল। তিনটি বিরোধী দল আরও বলে মাগুরা উপনির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে পুনরায় নতুন উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা না করলে তারা সংসদে ফিরে যাবে না। এ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে যখন সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনা চলতে থাকে তখন তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নতুন করে তোলে। তখনকার আওয়ামী লীগের বক্তব্য কতটা সঠিক ছিল সেটা বোঝা যায় সেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ চৌধুরী পরবর্তী জামায়াত-বিএনপি ঘরানার অন্যতম বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রকাশ্যে দেখা গেছে। যাহোক, সে আলোচনা নাইবা করলাম। এবার আসা যাক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রেক্ষাপট এবং প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা নিয়ে অতীত দিনের ঘটনাপ্রবাহর দিকে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামো সম্পর্কে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রথম যে কাঠামোটি উত্থাপন করা হয় তার শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে। তিনি হবেন সরকারের প্রধান নির্বাহী। তার অধীনে থাকবে একটি উপদেষ্টাম-লী। প্রথমে তাদের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়নি। তবে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ সরকারের দায়িত্ব হবে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তারা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেবেন। যেটা ছিল সময়ের দাবি। পরবর্তী সময়ে এ ধারণার পরিবর্তন ঘটে। বিরোধী দল প্রেসিডেন্টের অধীনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যাপারে রাজি হয়। বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েমের দাবি যখন জোরদার হয়েছে তখন তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেন। এজন্য তাকে তথ্যমন্ত্রীর পদ হারাতে হয় এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য তাকে শো-কজ করা হয়।

॥ দুই ॥

আওয়ামী লীগের পক্ষে ২৮-১০-৯৩ তারিখে জমাকৃত প্রথম বিলে প্রস্তাব করা হয় যে, রাষ্ট্রপতি দেশের প্রধান বিচারপতিকে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আহ্বান জানাবেন। তিনি যথাসম্ভব ছোট আকারে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবেন। পরবর্তী পর্যায়ে তারা নিজেরাই সংশোধিত যে বিলটি জমা দেন তাতে প্রস্তাব করা হয় : রাষ্ট্রপতি দেশের প্রধান বিচারপতি অথবা জাতীয় সংসদে বিদ্যমান সকল দলের ঐকমত্যে যে কোন ব্যক্তিকে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের আহ্বান জানাবেন, যিনি প্রধান উপদেষ্টারূপে গণ্য হবেন। আমরা এখন অনেকেই ভুলতেই বসেছি, ৯০ সালে তিন জোটের রূপরেখা হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক দলিল। কারণ, দুটি সঙ্কটকে সামনে রেখে প্রণীত হয়েছে এ রূপরেখা। আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল এরশাদ পতন এবং তার পতনের পর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠা। সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে গিয়ে তিন জোট তাদের দলিলকে সাংবিধানিক ভাষ্যে রূপ দেয়। তিন জোটের রূপরেখার চার ধারার (ক) উপধারায় বলা হয়েছে, জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির ভিত্তি হিসেবে সাংবিধানিক শাসনের ধারা নিরঙ্কুশ ও অব্যাহত রাখা হবে এবং অসাংবিধানিকভাবে যে কোন পন্থায় ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা প্রতিরোধ করা হবে। নির্বাচন ব্যতীত অসাংবিধানিক বা সংবিধান বহির্ভূত কোন পন্থায় কোন অবস্থাতে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না। আবার এটাও কথা ছিল বাংলাদেশে পরপর তিনবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু একানব্বই সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি সেটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর বিরোধী দল সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল, যা ছিল সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা।

ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলেই নির্বাচন হয় কেবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। ভোটে কারচুপির সম্ভাবনা কম থাকে। কিন্তু ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দল অংশ নেয়নি। ফলে নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল না। সরকারী দল আগেই বুঝেছিল এ নির্বাচন দিয়ে দেশ চালানো যাবে না। নির্বাচনের আগেও প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘এ নির্বাচন হচ্ছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন।’ এরকম কথা এখনকার বিএনপিমনা বুদ্ধিজীবীরা বলে থাকেন। এমনভাবে বলেন যেন বিএনপি সে সময় এমনি এমনি ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দল এ নির্বাচন বাতিলের দাবিতে অসহযোগ কর্মসূচী দিয়ে সৃষ্টি করেছিল সরকারবিহীন অবস্থা। বিরোধী দল কর্তৃক সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের জন্য দেশ-বিদেশের কূটনৈতিক মহল তৎপর হয়ে ওঠে। এর মধ্যস্থতা করার জন্য ১৯৯৪ সালের ১৫ সেপ্টেবর কমনওয়েলথ মহাসচিব এমেকা এনিয়াকু ঢাকায় আসেন এবং ১৯ সেপ্টেবর পর্যন্ত অবস্থান করেন। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেন। এমেকা ফিরে গিয়ে ২১ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে ফ্যাক্স পাঠান। ২৬ সেপ্টেবর উভয় নেত্রী আরেকটি ফ্যাক্সের মাধ্যমে সংলাপ শুরু করতে রাজি হন। সংলাপের বিষয়বস্তু ছিল তিন দফা। এর মধ্যে রয়েছে সৎ বিশ^াসের ভিত্তিতে সরকার ও বিরোধী উভয় দলের মুক্ত আলোচনার অঙ্গীকার, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে উভয়পক্ষের ঐকমত্য ও রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনায় আচরণবিধির উত্থাপন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যু। এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংলাপ শুরুর জন্য কমনওয়েলথ মহাসচিব এমেকা এনিয়াকুর প্রতিনিধি হিসেবে স্যার নিনিয়ান স্টিফান ১৩ অক্টোবর ঢাকায় আসেন। সেই সময় বিএনপির অবস্থান কতটা জাতীয় ঐক্যের পক্ষে ছিল?

॥ তিন ॥

বলা হয়ে থাকে পঞ্চম সংসদ (১৯৯১-এর সংসদ) ভেঙ্গে দেয়ার পর সাংবিধানিকভাবে অনির্বাচিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার কোন অবকাশ ছিল না। তখনকার সরকারী দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, অসাংবিধানিক উপায়ে কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েম করা যাবে না। যুক্তি দেখানো হয়েছিল, অস্থায়ী অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন সাংবিধানিকভাবে শপথ নিয়ে উপ-রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু সেই যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার কায়েম হওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কোন অবকাশ নেই। কারণ, অনির্বাচিত কোন ব্যক্তি সাংবিধানিক উপায়ে শপথ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন না। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় ঘোষণার পর থেকে সেই বিএনপি-জামায়াত-সুশীলের ভগ্নাংশরা কত যুক্তিই না দিয়ে যাচ্ছেন।

আমরা জানি, নাগরিক সমাজের এক অংশ সুযোগ পেলেই ‘জনতার মঞ্চ’ নিয়ে নানা ধরনের কথা বলে থাকে। কিন্তু পাঠকদের জানা থাকা উচিত কারা কারা ছিলেন সেখানে। ১৯৯৬ সালের ২৪ মার্চ প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর তার বেশ কয়েকজন সহযোগী নিয়ে প্রেসক্লাবের সামনে জনতার মঞ্চ থেকে অসহযোগ কর্মসূচীর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। ২৭ মার্চ ৩৫ জন সচিব ও ভারপ্রাপ্ত সচিব প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করে তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে অপারগতার কথা ঘোষণা করেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব আইয়ুবুর রহমানের নেতৃত্বে যারা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাত করেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আতাউল হক, সৈয়দ আহমদ, ফয়জুর রাজ্জাক, মুহিত চৌধুরী, মোফাজ্জল করিম, শফিউর রহমান, আইয়ুব কাদরী, আলমগীর ফারুক, মনজুরে মাওলা, ড. সাদাত হোসাইন, মোহাম্মদ আলী, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, শাহ আবদুল হান্নান, হাবিবুর রহমান, আমিরুল মুল্ক, আনোয়ারুল ইসলাম, ইসলাম উদ্দিন মালিক, মারগুব মোরশেদ, কাজী রকিব উদ্দীন, লুৎফুল্লাহিল মজিদ, রেজাউল হায়াত, ড. এ টি এম শামসুল হুদা। রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের সঙ্গে বৈঠকে পরিস্থিতি সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন আইয়ুবুর রহমান, আতাউল হক, মোহাম্মদ আলী, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, রেজাউল হায়াত, মোফাজ্জল করিম ও মুহিত চৌধুরী। আজকের বিএনপি ঘরানার অনেকেই সেই সময় জনতার মঞ্চের সঙ্গে ছিলেন। উপরের নামগুলো দেখলেই বোঝা যায় ।

আমরা জানি, আদর্শিক পার্থক্য গণতন্ত্র চর্চারই অংশ। কিন্তু কিছু জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐকমত্য দরকার। অন্তত এ ব্যাপারে একটি দরিদ্র দেশের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আমাদের দেশের মতোই নেপালের জনগণ ১৯৯০ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। তখন ঐ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নানা ধরনের মতাদর্শগত বিরোধে লিপ্ত ছিল। অনাস্থা ভোটে সরকারের পতন ঘটানো, রাজকীয় ফরমানের বলে সংসদ বাতিল, সুপ্রীমকোর্টের রায়ে সংসদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা, নতুন সরকার গঠন ইত্যাদি বিষয়ে দারিদ্র্যপীড়িত দেশটি ব্যস্ত থেকেছে। একটি দল অন্য দলকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়নি। কিন্তু জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জানি না পৃথিবীর কোন দেশে আমাদের দেশের মতো বিরোধী রাজনৈতিক দল বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দেয়। আর সেখানে ‘বিদ্যার জাহাজ’ বলে পরিচিতরা এসব ব্যাপারে দারুণ আগ্রহ দেখান।

পুনশ্চ : রাস্তায় গোপাল ভাঁড়ের সঙ্গে দেখা তার এক পরিচিত লোকের। ওই লোকের সঙ্গে ছিল আরও একজন। সে তাকে গোপালের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলল, ‘এই ভদ্রলোককে চেন? এঁর নাম বিদ্যাচরণ প-িত। একেবারে বিদ্যার জাহাজ। তোমার মতো গবেট নন।’ গোপাল এতে করে মোটেই বিচলিত হলো না। বেশ শান্তভাবেই বলল, ‘বিদ্যার জাহাজকে রাস্তায় রেখেছেন কেন? জলে ভাসিয়ে দিলেই তো ভালো হয়।’

দৈনিক জনকণ্ঠ

প্রকাশকালঃ ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত