উন্নয়নের অগ্রযাত্রা এবং ‘গণতান্ত্রিক’ শাসনের মাত্রাঃ অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী

6487

Published on জানুয়ারি 17, 2018
  • Details Image

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ঐকমত্যের সরকারের চার বছর পূর্ণ হয়েছে ১২ জানুয়ারি ২০১৮। অগ্নিবোমা ও সহিংস হামলার দ্বারা বাধাগ্রস্ত করার ‘অপচেষ্টা’ সত্ত্বেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে জয়লাভের এক সপ্তাহ পর ১২ জানুয়ারি ঐকমত্যের সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন। এই চার বছরে দেশের সার্বিক উন্নয়নে পূর্বঘোষিত লক্ষ্য পূরণে বেশ কিছু সাফল্য দেখাতে পেরেছে সরকার। জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের পাল্লাই ভারী বলে বিভিন্ন বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে। চার বছর পূর্তি উপলক্ষে দেশে উন্নয়ন মেলার সূচনা করা হয়েছে। এই উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চাঁদপুরের একজন মৎস্যজীবীর সঙ্গে, বরগুনা আশ্রয় প্রকল্পের সুবিধাভোগী একজনের সঙ্গে, ঝিনাইদহের এককালের ভিক্ষুক মর্জিনা বেগমের সঙ্গে, হবিগঞ্জে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের একজন উপকারভোগী ও একজন চা শ্রমিকের সঙ্গে, গাইবান্ধার একজন সরকারি ভাতাভোগী ও মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই উন্নয়ন যেন অব্যাহত থাকে সেই লক্ষ্য নিয়েই এই উন্নয়ন মেলার সূচনা।’

শাসনের মাত্রা বা ‘ডিগ্রি অব গভর্নমেন্ট’-এর ওপরই নির্ভর করে একটি দেশের উন্নয়ন বা অনুন্নয়ন। ‘ডিগ্রি অব গভর্নমেন্ট’ দেশের ‘পলিটিক্যাল অর্ডার’ বাস্তবায়নের প্রতিফলন। বাংলাদেশের উন্নয়নের দুর্বার গতি আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছে। জগদ্বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন ‘পলিটিক্যাল অর্ডার’ সম্পর্কিত তার বিখ্যাত ধারণাটি ব্যক্ত এবং ব্যাখ্যা করেছেন চড়ষরঃরপধষ ঙৎফবৎ রহ ঈযধহমরহম ঝড়পরবঃরবং শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে। হান্টিংটন যতগুলো গবেষণা গ্রন্থ লিখেছেন সেগুলোর মধ্যে এই গ্রন্থটিকে সর্বাধিক শক্তিশালী, মৌলিক এবং তাত্তি¡ক কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। আর এই বইটি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা সামাজিক বিজ্ঞানসমূহের একাডেমিক সাহিত্যের জগতে সর্বাধিক প্রভাবশালী গ্রন্থের স্থায়ী মর্যাদা লাভ করেছে। এই বইটি যখন প্রকাশিত হয়েছিল তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল। হান্টিংটন বলছেন, “

The United States, Great Britain, and the Soviet Union have different forms of government, but in all three systems the government governs…These governments command the loyalties of their citi“ens and thus have the capacity to tax resources, to conscript manpower, and to innovate and to execute policy. In all these characteristics, the political systems of the United States, Great Britain and the Soviet Union differ significantly from the governments which exist in maû, if not most, of the moderni“ing countries of Asia, Africa, and Latin America

.” অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে বিভিন্ন প্রকারের সরকার আছে, কিন্তু এই তিন ব্যবস্থাতেই সরকার শাসন করে…। এই সরকারগুলো তাদের নাগরিকদের আনুগত্য পেয়ে থাকে এবং এভাবে ট্যাক্স আরোপ করার, মানবসম্পদ নিয়ন্ত্রণ করার এবং সরকারি নীতি উদ্ভাবন ও বাস্তবায়নের সক্ষমতা তাদের রয়েছে। এসব বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে, বেশিরভাগ না হলেও, এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিদ্যমান অনেক দেশের সরকার থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন এবং (তৎকালীন) সোভিয়েত ইউনিয়ন তাৎপর্যপূর্ণভাবে ভিন্ন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৮ তারিখে ৮১ বছর বয়সে হান্টিংটন মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার যুক্তি এখনো খুবই প্রাসঙ্গিক ও শক্তিশালী।

১৯৯৭ সালে ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ জার্নালে নিয়মিত বুক রিভিউয়ার হিসেবে কাজ করার সময় আর একজন জগদ্বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা বিগত ৭৫ বছরে যেসব গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে হান্টিংটনের ‘পলিটিক্যাল অর্ডার’ গ্রন্থটিকে প্রথম পাঁচটির অন্যতম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। হান্টিংটনের এই বই প্রথম (১৯৬৮ সালে) প্রকাশিত হওয়ার পরে বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭১ সালে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামের একটি দেশ আবির্ভূত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের শত্রুরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে পাকিস্তানি স্টাইলে ‘সামরিক-বেসামরিক স্বৈরাচারী আমলাতান্ত্রিক শাসন’ কায়েম হয়েছিল। এরপর ১৯৯০-এর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে। দুই জার্মানিকে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর দুই পরাশক্তির মধ্যে বিভক্তকারী ‘বার্লিন দেয়াল’ জনতার রুদ্ররোষের কবলে পড়ে ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হয়েছে। বার্লিন দেয়াল ধ্বংস এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন ও প্রকাশ্য তৎপরতাকে দায়ী করা হয়ে থাকে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের প্রায় তিন দশক পরে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলের জন্য রাশিয়ার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ‘হ্যাকিং’ তৎপরতাকে দায়ী করা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ১৪ দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে’ ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সমাপ্ত চার বছরে সরকারের সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। মূলত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে যে সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল তারা ‘রাজনৈতিক বৈধতার’ তকমা লাগানোর জন্য এমন কোনো অবৈধ কাজ নেই যা না করেছেন। তবে ইতিহাসের কষ্টিপাথরে তাদের সেসব শাসনামল ‘অবৈধ’ হিসেবেই গণ্য হতে থাকবে। দেশের উচ্চতর আদালত থেকে প্রথম সামরিক শাসক কর্তৃক ঘোষিত ও বৈধ হিসেবে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায় তাই প্রমাণ করে। বর্তমান সরকারের সময় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনাকাক্সিক্ষত কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অনেক ষড়যন্ত্র করা সত্ত্বেও, তা সৃষ্টি হচ্ছে না তার অন্যতম কারণ হচ্ছে ‘পলিটিক্যাল অর্ডার’ বজায় রাখতে পারা। আসলে এটি হচ্ছে ‘পলিটিক্যাল অর্ডার’ বজায় থাকা না থাকা সম্পর্কিত একটি লক্ষণ। বিশ্বখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন বাস্তব পরিস্থিতি থেকে উপাদান সংগ্রহ করে ‘পলিটিক্যাল অর্ডারের’ প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছেন। তার মতে, …political order was a good thing in itself and would not automatically arise out of the moderni“ation process….Without political order, neither economic nor social development could proceed successfully. অর্থাৎ রাজনৈতিক অর্ডার বা সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সম্পর্কিত আদেশ-নির্দেশ বা কর্মকাণ্ড নিজে থেকেই একটি উত্তম ব্যাপার এবং এটি আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঠে আসবে না…। রাজনৈতিক অর্ডার ছাড়া, না অর্থনৈতিক না সামাজিক উন্নয়ন সফলতার সঙ্গে এগোতে পার না। পলিটিক্যাল অর্ডার সম্পর্কিত হান্টিংটনের এই পর্যবেক্ষণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত চড়ষরঃরপধষ ঙৎফবৎ রহ ঈযধহমরহম ঝড়পরবঃরবং শীর্ষক গ্রন্থে।

এই গ্রন্থের শুরুতেই হান্টিংটন বলছেন, The most important political distinction among countries concerns not their form of government but their degree of government. কোন ধরনের সরকার- তা নয় বরঞ্চ দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পার্থক্য হচ্ছে সরকারের মাত্রা বা ডিগ্রি। হান্টিংটনের যুক্তি হচ্ছে নিয়ম বা আদেশ-নির্দেশ বাস্তবায়ন করা নিজেই একটি জটিল ব্যাপার। সরকারের ধরন দিয়ে নয় ‘গৃহীত নিয়ম বা সিদ্ধান্ত বা আদেশ-নির্দেশ অনুযায়ী সরকার পরিচালিত হচ্ছে কিনা’ তাই দিয়েই সরকারের কার্যকারিতা বিবেচনা করতে হয়।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকাকালে দেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল। কিন্তু ১৫ আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে সবকিছু পাল্টে যেতে থাকে। এরপর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার সরকার গঠনের পর বেশকিছু উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ‘উন্নয়ন’ কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন এবং তা অব্যাহত রাখার বিষয়টি বাধা-বিপত্তির ‘দুর্গমগিরি’ অতিক্রম করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে। সরকারের চার বছর পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সবার সহযোগিতা চেয়েছেন। তাঁর ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো যেন সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়, সে জন্য সবার সহযোগিতা একান্তভাবে দরকার।’

গত ১১ জানুয়ারি সরকারের চার বছর পূর্তিতে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের ৬৪ জেলার ৪৯২টি উপজেলায় তিনদিনব্যাপী উন্নয়ন মেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই মেলায় আজকে যারা সম্পৃক্ত রয়েছেন তাদের বলব, যে কাজগুলো আমরা করতে পেরেছি এবং যে কাজগুলো ভবিষ্যতে করার পরিকল্পনা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা দরকার।’ অনুষ্ঠানে সরকার প্রধান আরো বলেন, ‘আমাদের উন্নয়নটা হচ্ছে সার্বিকভাবে সব জনগণের জন্য। আর বিশেষ করে আমাদের গ্রামের মানুষের জন্য। আমরা প্রতিটি গ্রামকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে চাই; চলাফেরার জন্য রাস্তাঘাট উন্নত করতে চাই। উন্নয়ন মানে হচ্ছে জনগণের উন্নয়ন। গ্রামের মানুষ, তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের উন্নয়ন। এই উন্নয়ন হচ্ছে সার্বিকভাবে (দেশকে) বিশ্ব দরবারে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে।’

লি কুয়ান ইউর রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে সিঙ্গাপুর ১৯৬৫ সালের ৫১৬ মার্কিন ডলার মাথাপিছু আয় থেকে আজ ৫৬২৮৪ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ৫৪৩ ডলারের মাথাপিছু আয়ের দেশটির মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৬১০ ডলার (১৪ নভেম্বর ২০১৭ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন)। ২০০৫-০৬ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ছিল সাড়ে ৪১ শতাংশ। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ৩ শতাংশে; আর অতিদারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ দশমিক ২৩ শতাংশ, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১২ শতাংশে। (৩১ জানুয়ারি ২০১৭ পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের জাতীয় সংসদে দেয়া তথ্য) প্রধানমন্ত্রী তার বছর পূর্তির ভাষণে বলেছেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ১৫-১৬ শতাংশে এবং অতিদারিদ্র্যের হার ৭-৮ শতাংশে নামিয়ে আনা।’

লি কুয়ান ইউর সিঙ্গাপুর প্রথমে ১৯৬৩ সালে যুক্তরাজ্য থেকে, পরে ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়া থেকে স্বাধীন হওয়ার সময়ে উন্নয়নের এমন কোনো মডেল ছিল না। লি. পরবর্তীকালে তৈরি করেছিলেন। ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দিকে লি শ্রীলঙ্কা থেকে জ্যামাইকা পর্যন্ত সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশসমূহে ভ্রমণ করে সাফল্যের কাহিনী অনুসন্ধান করেছেন। সৌভাগ্যবশত তিনি ভিন্ন মডেল অনুসরণ করেছিলেন। তিনি নেদারল্যান্ডসের নগর পরিকল্পনা এবং ভূমি উদ্ধার এবং রাজকীয় ডাচ শেল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কাঠামো এবং উপযুক্ত কৌশল-প্রণয়ন সম্পর্কে অধ্যয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। কৌতুক করে বলা হয় সিঙ্গাপুর হচ্ছে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ভালোভাবে পরিচালিত একটি কোম্পানি। এটি এমন কেন, এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে লি।

নেতৃত্ব সম্পর্কে লি বলছেন, সর্বাধিক দক্ষ নেতা হচ্ছেন তিনি যাকে মানুষ ভয় পায়। (The most efficient leader is a feared leader.) ইনসেনটিভসের গুরুত্ব সম্পর্কে লি. কুয়ান ইউ বলছেন, একটি সংগঠন, করপোরেশন অথবা একটি দেশের দীর্ঘমেয়াদি সফলতার ক্ষেত্রে একক নির্ধারক উপাদান হচ্ছে সঠিক ইনসেনটিভস প্রদান করা। নেতৃত্বের ভূমিকার কারণেই জনগণ সিস্টেমে কড়াকড়িভাবে কাজ করবে এবং সেহেতু মানুষের পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকু কঠিন করুন। (Putting the right incentives in place is THE single most important factor determining the long-term success of an organi“ation, corporation, or a country. It is the leadershipÕs role to assume that people will game the system ruthlessly, and therefore make it as hard as humanly possible to do that.)

কীভাবে সিঙ্গাপুর স্টাইলে সামর্থ্যরে মধ্যে গৃহায়ন এবং বিশাল পেনশন ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দরকার সে সম্বন্ধে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রফেসর জোসেফ স্টিগলিৎস ২০১৩ সালে প্রবন্ধ প্রকাশ করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। এ ছাড়া ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের র‌্যাংক অনুযায়ী, লি. কুয়ান ইউ সিঙ্গাপুরকে টোকিওর পরে, বিশ্বের দ্বিতীয় নিরাপদতম নগরীতে পরিণত করেছিলেন। লি’র মতে, এর মূলে আছে ‘আইনশৃঙ্খলা’। তবে লি. একটু ঘুরিয়ে বলতেন এবং বুঝতেন। বলতেন ‘প্রথম হচ্ছে শৃঙ্খলা, তারপরে হচ্ছে আইন’ Order first, then law. অবশ্য লি.র মতে, শৃঙ্খলা বা অর্ডার হচ্ছে জনগণের নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক প্রেডিক্ট্যাবিলিটি। ক্যাম্ব্রিজে আইনের ডিগ্রিপ্রাপ্ত লি. তার রাজনৈতিক জগতে ভবিষ্যতে প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে উঠতে পারে এমন কোনো ব্যক্তিকে আতঙ্কিত করা বা বশে আনার পদক্ষেপ নিতে পিছপা হতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে একটি জটিল বিশ্বে কেউ স্ববিরোধিতার ভয়ে ভীত থাকতে পারে না। তার একটি স্মরণীয় কথা হচ্ছে ‘I always tried to be correct, not politically correct.’ বাংলাদেশও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পাশাপাশি উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের আর কোনো দেশ উন্নতির এমন অসাধ্য সাধন করতে পারেনি, যেমন পেরেছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতাও এক সময় অসাধ্য ছিল কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তা সম্ভব হয়েছে। একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে, নিম্ন মধ্যম আয়ের পথ পেরিয়ে, উন্নত বাংলাদেশে পরিণত হওয়ার দিকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলার কাণ্ডারি, দেশরতœ শেখ হাসিনা। উপসাগরীয় দেশগুলো সর্বদা সমর-সজ্জিত এবং জঙ্গিবাদের সূতিকাগার, আইএস জঙ্গি তৎপরতায় জর্জরিত এবং সামরিক অভ্যুত্থান ও তেলের মূল্য পতনের কাছে এগুলো ভঙ্গুর। আফ্রিকাও নানা ধরনের উপজাতীয় সংঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। ঔপনিবেশিক শোষণের ক্ষতি সারিয়ে তুলতে আরো অর্ধ শতাব্দী দরকার হবে আফ্রিকার। উপমহাদেশের মধ্যে পাকিস্তান জঙ্গিরাষ্ট্র হিসেবে গণ্য হচ্ছে। ভারত সবেমাত্র ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা শুরু করেছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গ বলছে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থানে দ্বিতীয়। এবার শীর্ষস্থানটি দখল করবে ভারত। তবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অনেক সূচকে বাংলাদেশ ভারতকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। কারণ শুধুমাত্র গড় মাথাপিছু আয়ই একটি দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, স্যানিটেশন প্রভৃতির নিশ্চয়তা দিতে পারে না। বাংলাদেশ এসব সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও এটি বলেছেন। অপরদিকে, বিংশ শতাব্দীব্যাপী শ্রীলঙ্কা ছিল আর্থ-সামাজিক উন্নতিতে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে। কিন্তু জাতিগত দাঙ্গার ক্ষত এবং অন্যান্য কারণে দেশটি বাংলাদেশের পেছনে পড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড দ্বারা ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার পথে রয়েছে। আন্তর্জাতিক মহল চেষ্টা করছে এই দুটি রাষ্ট্রকে সুষ্ঠু পথে ফিরিয়ে আনতে। দারিদ্র্যের অভিশাপ ও ভূমিকম্পের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আর একটি ল্যান্ড-লকড দেশ নেপালের আরো সময় প্রয়োজন হবে। নেপাল ও ভুটান অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে একবিংশ শতাব্দীর বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের উন্নতি এখন বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। বাংলাদেশের এই অভাবনীয় অগ্রগতির মূল কারণ হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব। লি. কুয়ান ইউ ধারাবাহিকভাবে তিন দশক সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে উন্নতির শীর্ষে তার দেশকে পৌঁছে দিয়েছেন। বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্যও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের ধারাবাহিকতা থাকা প্রয়োজন।

অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ও পরিচালক, সাউথ এশিয়ান স্টাডি সার্কেল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সৌজন্যেঃ ভোরের কাগজ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত